বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

হাফেয শিক্ষার্থীদের পুরনো কুরআন পোড়ানে বা ফেলার বিধান

কুরআনুল কারিমের পুরনো পৃষ্ঠা পোড়ানোর বিধান
কুরআনুল কারিম যদি পুরনো হয়, তার পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে যায় ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়, তাহলে এমন জায়গায় রাখা যাবে না, যেখানে অসম্মানের সম্মুখীন হয়, ময়লা-আবর্জনায় পতিত হয়, মানুষ বা জীব-জন্তু দ্বারা পিষ্ট হয়। যদি বাঁধাই করে পাঠ উপযোগী করা সম্ভব হয়, তাহলে পরিত্যক্ত না রেখে ব্যবহার করা শ্রেয়। প্রকাশক, মুদ্রাক্ষরিক বা কারো অবহেলা ও ভুলের কারণে কুরআনুল কারিম যদি ভুল মুদ্রিত হয়, তাহলে সংশোধন করে পাঠ উপযোগী করা জরুরি। পাঠ-উপযোগী করা সম্ভব না হলে অসম্মান ও বিকৃতি থেকে সুরক্ষার জন্য মুসহাফগুলো পোড়ানো কিংবা নিরাপদ স্থানে দাফন করা জরুরি। শায়খ সালেহ আল-ফাওযান বলেন: “ব্যবহার অনুপযোগী কুরআন পোড়ানো ও দাফন করা উভয় পদ্ধতি সাহাবিদের থেকে প্রমাণিত”।
পুরনো কুরআন দাফন করার সিদ্ধান্ত হলে পবিত্র স্থানে দাফন করবে, ভবিষ্যতে যেখানে অপমানের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনেক সালফে সালেহীন রহ. তাদের পুরনো কুরআন মসজিদে দাফন করেছেন। ইমাম আহমদ রহ. বলেন: “আবুল জাওযা রাহিমাহুল্লাহর একটি কুরআন পুরনো হয়ে গিয়েছিল, অতঃপর মসজিদে গর্ত করা হয়, তিনি সেখানে তা দাফন করেন”। অতএব মসজিদ বা মসজিদের জায়গায় পুরনো কুরআন দাফন করা কোনো সমস্যা নয়।
পুরনো কুরআন সুরক্ষার দ্বিতীয় পদ্ধতি পোড়ানো। ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন:
্রفَأَرْسَلَ عُثْمَانُ إِلَى حَفْصَةَ أَنْ أَرْسِلِي إِلَيْنَا بِالصُّحُفِ نَنْسَخُهَا فِي الْمَصَاحِفِ ثُمَّ نَرُدُّهَا إِلَيْكِ ، فَأَرْسَلَتْ بِهَا حَفْصَةُ إِلَى عُثْمَانَ ، فَأَمَرَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ ، وَعَبْدَ اللَّهِ بْنَ الزُّبَيْرِ ، وَسَعِيدَ بْنَ الْعَاصِ ، وَعَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ الْحَارِثِ بْنِ هِشَامٍ ، فَنَسَخُوهَا فِي الْمَصَاحِفِ …وَأَرْسَلَ إِلَى كُلِّ أُفُقٍ بِمُصْحَفٍ مِمَّا نَسَخُوا ، وَأَمَرَ بِمَا سِوَاهُ مِنْ الْقُرْآنِ فِي كُلِّ صَحِيفَةٍ أَوْ مُصْحَفٍ أَنْ يُحْرَقَগ্ধ.
“… অতঃপর উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট বলে পাঠান, আমার নিকট মুসহাফগুলো পাঠিয়ে দিন, আমরা তা একাধিক মুসহাফে নকল করে আপনার নিকট ফেরত পাঠাব, ফলে তিনি উসমানের নিকট তা পাঠিয়ে দেন। উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জায়েদ ইবনে সাবেত, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, সায়িদ ইবনে আস ও আব্দুর রহমান ইবনে হারেস ইবনে হিশামকে নির্দেশ দেন, তারা অনেক মুসহাফ তৈরি করেন… অতঃপর তাদের লিখিত এক-এক কপি তিনি প্রত্যেক অঞ্চলে প্রেরণ করেন এবং তা ব্যতীত অন্যান্য সহিফা ও মুসহাফে সংরক্ষিত কুরআন পোড়ানোর নির্দেশ দেন”।
কোনো সাহাবি উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বিরোধিতা করেননি, ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যদিও ইখতিলাফ করেছেন, কিন্তু তা কুরআন পোড়ানো সংক্রান্ত ছিল না, বরং তার ইখতিলাফ ছিল এক-ভাষার কুরআন রেখে অন্যান্য ভাষার কুরআন নিঃশেষ করা সংক্রান্ত।
পুরনো কুরআন দাফন করা অপেক্ষা পোড়ানো উত্তম। কারণ সাহাবিদের উপস্থিতিতে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কুরাইশি ভাষা ব্যতীত অন্যান্য ভাষার কুরআন পুড়িয়েছেন। দ্বিতীয়ত দাফনকৃত কুরআনের উপর থেকে কখনো মাটি সরে অসম্মানের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই পুরনো কুরআন পোড়ানো ও পোড়ানোর পর ছাইগুলো দাফন করা অধিক শ্রেয়।
পুরনো কুরআন পানিতে ফেলার কোনো দলিল নেই, কোনো আদর্শ পূর্বপুরুষ এরূপ করেছেন মর্মে আমাদের নিকট কোনো তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত পানিতে ভাসমান যে কোনো কাগজ ময়লা ও আবর্জনার স্থানে গিয়ে ঠেকতে পারে, তাই এ পদ্ধতি গ্রহণ করা ঠিক নয়।
শায়খ আব্দুর রহমান সুহাইম বলেন: “কুরআনুল কারিমের পুরনো ও ব্যবহার অনুপযুক্ত পৃষ্ঠা প্রযুক্তির সাহায্যে পুনরায় ব্যবহার করা বা অন্য কোনো কাজে লাগানো বৈধ নয়, বরং নিরাপদ স্থানে দাফন করা কিংবা পোড়ানো জরুরি”।
আল্লাহর নাম, কুরআনের আয়াত কিংবা দোয়া ও যিকর সংক্রান্ত কাগজের সাথে সম্মানের ব্যবহার করা জরুরি। অনুরূপ হাদিসের কিতাবের সাথে সম্মানের আচরণ করা জরুরি, যদিও তার মর্যাদা কুরআনুল কারিমের সমান নয়। অতএব রাস্তায় পরে থাকা কিংবা বাজার-সদাইয়ের কাগজে যদি আল্লাহর নাম, কুরআনের আয়াত কিংবা হাদিসের অংশ বিশেষ থাকে, দীন হিসেবে আমরা তার সাথে সম্মানের ব্যবহার করব। আল্লাহ তাওফিক দানকারী।

অজু ব্যতিত শিক্ষার্থীদের কুরআন ধরার বিধান

অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করার বিধান
অধিকাংশ আলেমের মতে অযু ব্যতীত মুসহাফ/ কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা বৈধ নয়। ইমাম আবু হানিফা , মালিক , শাফেয়ী , আহমদ ইবনে হাম্বল ও শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ প্রমুখগণ এ মত পোষণ করেছেন। সাহাবিদের ফতোয়াও তাই ছিল। দলিল হিসেবে তারা পেশ বলেন:
১. ইয়ামানের গভর্নর আমর ইবনে হাযম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখে পাঠান:
্রأَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌগ্ধ.
“পবিত্র সত্তা ব্যতীত কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না”।
“হাদিসটি মুত্তাসিল ও মুরসাল উভয় সনদে বর্ণিত, ইমাম মালিক মুরসাল এবং ইমাম নাসায়ী ও ইবনে হিব্বান রহ. মুত্তাসিল বর্ণনা করেছেন, প্রকৃতপক্ষে হাদিসটি মুরসাল, মুত্তাসিল নয়। ইমাম আহমদ রহ. বলেন: আশা করছি হাদিসটি সহি। আসরাম বলেন: ইমাম আহমদ হাদিসটি দলিল হিসেবে পেশ করেছেন”।
ইবনে হাজার রহ. ইবনে তাইমিয়ার কথা সংক্ষেপ করে বলেন: এক দল ইমাম হাদিসটি সহি বলেছেন, সনদের বিবেচনায় নয়, প্রসিদ্ধির বিবেচনায়”। তারা দ্বিতীয় দলিল হিসেব পেশ করেন কুরআনুল কারিমের নিম্নোক্ত আয়াত:
২. আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّهُۥ لَقُرۡءَانٞ كَرِيمٞ ٧٧ فِي كِتَٰبٖ مَّكۡنُونٖ ٧٨ لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ٧٩ ﴾ [الواقعة: ٧٧، ٧٩]
“নিশ্চয় এটি মহিমান্বিত কুরআন, যা সুরক্ষিত কিতাবে রয়েছে, কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া”।
দলিল হিসেবে এ আয়াত পেশ করা দুরস্ত নয়, কারণ পূর্বাপর বিষয় থেকে স্পষ্ট যে, পবিত্রগণ ব্যতীত যে কিতাব কেউ স্পর্শ করে না তা মাকনুন কিতাবে বিদ্যমান। মাকনুন কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য লাওহে মাহফুয”। আর لَا يَمَسُّهُ এর সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য লাওহে মাহফুয, কারণ এটাই তার নিকটতম বিশেষ্য। অর্থাৎ লাওহে মাহফুযে বিদ্যমান কুরআনুল কারিমকে পবিত্র সত্ত্বা মালায়েকা বা ফেরেশতাদের ব্যতীত কেউ স্পর্শ করে না। অতএব দুনিয়ার জমিনে বিদ্যমান কুরআনুল কারিম স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত এ আয়াত তার দলিল নয়।
ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন: “শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: আসমানে বিদ্যমান সহিফাগুলো যখন পবিত্র সত্তা ব্যতীত কেউ স্পর্শ করে না, আমাদের হাতে বিদ্যমান সহিফাগুলো আমরা পবিত্র অবস্থা ব্যতীত স্পর্শ করব না, এটাই সতর্কতা, সাবধানতা ও মালায়েকাদের সাথে সামঞ্জস্যতা। বস্তুত এ আয়াত থেকে হাদিসটি নিঃসৃত হয়”। অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা যাবে না পক্ষে তারা তৃতীয় দলিল পেশ করেন সাহাবিদের আমল।
৩. ইসহাক ইবনে রাহওয়েহ বর্ণনা করেন, “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ অযুসহ কুরআনুল কারিম স্পর্শ করতেন”। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: সালমান ফারসি, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ও অন্যান্য সাহাবি কুরআন স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত করতেন, কোনো সাহাবি তাদের বিরোধিতা করেননি”।
কতক আলেম বলেন, কুরআনুল কারিম স্পর্শ করার জন্য অযু করা মোস্তাহাব, জরুরি নয়। এটা জাহেরিয়াদের মাযহাব, ইবনে হাযম রহ. এ মতকে শক্তিশালী করেছেন। তাদের দলিল:
১. তিলাওয়াত করার জন্য মুসহাফ শরীফ স্পর্শ করা সাওয়াবের কাজ, দলিল ব্যতীত তাতে অযু শর্ত করা যাবে না, কারণ তখন যাদের অযু নেই তারা এ সাওয়াব থেকে মাহরূম হবে। আর প্রমাণিত যে, কুরআন ও সহি হাদিসে তার পক্ষে কোনো দলিল নেই, তাই কুরআন স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত করা যথাযথ নয়।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসরার প্রধান হিরাকলকে নিম্নোক্ত আয়াতসহ পত্র লিখেন:
﴿يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ كَلِمَةٖ سَوَآءِۢ بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمۡ أَلَّا نَعۡبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشۡرِكَ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَتَّخِذَ بَعۡضُنَا بَعۡضًا أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِۚ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُولُواْ ٱشۡهَدُواْ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ٦٤ ﴾ [ال عمران: ٦٤]
‘হে কিতাবিগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করব না। আর তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করব না এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ছাড়া রব হিসাবে গ্রহণ করব না। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, ‘তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম”।
ইবনে হাযম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, খৃস্টানদের নিকট উক্ত আয়াতসহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পত্র প্রেরণ করা প্রমাণ করে অযু ও ইমান ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা বৈধ।
উত্তর: এ হাদিস সম্পর্কে জমহুর আলেমগণ বলেন, পত্রের আয়াত কুরআনুল কারিমের হুকুম রাখে না, তা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যের অংশ, অথবা তাফসির গ্রন্থে বিদ্যমান আয়াতের মত একটি আয়াত, যা অযু ব্যতীত স্পর্শ করা বৈধ।
৩. মুসলিমরা তাদের বাচ্চাদের অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করার অনুমতি দিয়ে আসছেন, যদি অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা হারাম হত তারা কখনো তার অনুমতি প্রদান করতেন না।
উত্তর: এ যুক্তি সম্পর্কে জমহুর বলেন, প্রয়োজনের খাতিরে তারা অনুমতি প্রদান করেন, অযু ব্যতীত বাচ্চাদের কুরআন পড়া নিষেধ করা হলে তারা কুরআন থেকে বিমুখ হবে, তাই মুসলিমদের এ আমল দলিল হিসেবে পেশ করা যৌক্তিক নয়।
শায়খ উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ প্রথম বলতেন অযু ব্যতীত কুরআন স্পর্শ করা বৈধ, পরবর্তীতে তিনি এ ফতোয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। তার প্রথম বক্তব্য ছিল:
্রأَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌগ্ধ.
“মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না”। তিনি ‘তাহির’ শব্দের অর্থ বলতেন মুমিন। পরবর্তীতে তিনি বলেন طاهرٌ শব্দের অর্থ মুমিন নয়, বরং পবিত্র ব্যক্তি, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো মুমিন ব্যক্তিকে ‘তাহির’ বলেননি। দ্বিতীয়ত অযুর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجۡعَلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ حَرَجٖ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ ٦﴾ [المائ‍دة: ٦]
“আল্লাহ তোমাদের উপর কঠিন করতে চান না, তবে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান”। অতএব ‘তাহির’ অর্থ পবিত্র, তাই কোনো ব্যক্তি পবিত্র অবস্থা ব্যতীত কুরআন স্পর্শ করবে না, তবে রোমাল, অথবা হাত মোজা অথবা মিসওয়াক দ্বারা কুরআনুল কারিমের পৃষ্ঠা উল্টানো বৈধ”। এটাই শায়খের সর্বশেষ ফতোয়া, তিনি বলেন:
্রفالذي تَقَرَّرَ عندي أخيراً: أنَّه لا يجوز مَسُّ المصْحَفِ إلا بِوُضُوءগ্ধ.
“সর্বশেষ আমার নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, অযু ব্যতীত মুসহাফ স্পর্শ করা বৈধ নয়”।
কুরআন স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত ফতোয়াই সঠিক। বিশেষ করে পূর্বাপর সকল মনীষী তার উপর আমল করেছেন। ইবনে হাযম রাহিমাহুল্লার দলিল খুব দুর্বল, তবে বাচ্চাদেরকে অযুর জন্য বাধ্য করা, কিংবা অযু না থাকার অজুহাতে বড়দের কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত থেকে বিরত খাতা বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ, সবাই বলেছেন আড়াল দ্বারা মুসহাফ শরীফ স্পর্শ করা বৈধ। অতএব যত বেশী সম্ভব কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন, সর্বাবস্থায় অযুর হালতে থাকার চেষ্টা করুন। যদি অযু না থাকে, কিংবা অযু করা সময় সাপেক্ষ বা কষ্টকর হয়, তাহলে আড়ালসহ ধরে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন। অসতর্কতা কিংবা বেখেয়ালে কুরআনুল কারিমের সাথে শরীরের কোনো অংশের স্পর্শ হলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চান, শরীরের সাথে কুরআনুল কারিমের স্পর্শ হবে আশঙ্কায় তবুও দেখে তিলাওয়াত করা ছাড়বেন না। কারণ, স্পর্শ হবে আশঙ্কায় তিলাওয়াত ত্যাগ করার তুলনায় তিলাওয়াতের সময় স্পর্শের পর তওবা করা অনেক ভালো। বিশেষভাবে যেহেতু এতে দ্বিমত রয়েছে, তাই সামান্য হলেও অযু করার বিষয়টি হালকা হয়।
উল্লেখ্য, কাপড় বা শরীরের কোনো অংশ নাপাক হলে অযু নষ্ট হয় না, মুসলিম বোনেরা বিষয়টি ভালোভাবে মনে রাখুন, অতএব ছোট বাচ্চা যদি আপনার শরীর বা কাপড়ে পেশাব করে, কিংবা তার পায়খানার দাগ আপনার কাপড়ে দেখা যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ের জন্য তিলাওয়াত ত্যাগ করবেন না, কারণ তখন আপনার সুযোগ নাও হতে পারে। অনুরূপ নাপাক বিছানা কিংবা নাপাক চেয়ারে বসে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা সমস্যা নয়। এ কথাও ঠিক যে, কুরআন তিলাওয়াতকারী আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথা বলে, তাই তার কাপড়, শরীর ও জায়গা পাক হওয়া তিলাওয়াত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব। আল্লাহ ভালো জানেন।

হিফজ বিভাগের শিক্ষাথীদের শাস্তি বা এর সীমারেখা

শাস্তি প্রদান করার বিধান
ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকদের নিকট আমানত। তারা শিক্ষার্থীদের ভদ্র আচরণ, ইলম ও আখলাক শেখাবেন, একান্ত প্রয়োজন হলে উত্তম-মাধ্যম করবেন। এটাই হানাফি , মালিকি , শাফেয়ী ও হাম্বলি ফকিহদের অভিমত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِগ্ধ.
“তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, সবাইকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে”। অপর হাদিসে তিনি বলেন,
্রلَا يَسْتَرْعِي اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَبْدًا رَعِيَّةً، قَلَّتْ أَوْ كَثُرَتْ، إِلَّا سَأَلَهُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، أَقَامَ فِيهِمْ أَمْرَ اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَمْ أَضَاعَهُ؟ حَتَّى يَسْأَلَهُ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ خَاصَّةًগ্ধ.
“আল্লাহ কোনো বান্দাকে যখন কোনো দায়িত্ব প্রদান করেন, কম হোক বা বেশী হোক, তিনি অবশ্যই তাকে কিয়ামতের দিন সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, সে কি তাদের (অধীনদের) মাঝে আল্লাহর বিধান কায়েম করেছে, না বিনষ্ট করেছে? অবশেষে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে বিশেষভাবে”।
এ হাদিস বলে শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই দায়িত্বশীল। শিক্ষার্থী বা পরিবারের কোনো সদস্য অবাধ্য হলে প্রথমত মারধর ব্যতীত শোধরানোর অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করুন। তাদের সাথে নম্র আচরণ করুন, পর্যায়ক্রমে সহজ থেকে কঠোর হোন। ওমর ইবনে আবু সালামাহ বলেন,
্রكُنْتُ غُلَامًا فِي حَجْرِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَتْ يَدِي تَطِيشُ فِي الصَّحْفَةِ، فَقَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: يَا غُلَامُ، سَمِّ اللَّهَ وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَগ্ধ.
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে ছোট বাচ্চা ছিলাম, আমার হাত প্লেটের চতুর্দিক যেত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে গোলাম, আল্লাহর নাম বল, তোমার ডান হাতে খাও ও তোমার সামনে থেকে খা”।
শিক্ষার্থী কিংবা ঘরের সন্তান যদি ফরজের ক্ষেত্রে অবহেলা কিংবা ওয়াজিবের ক্ষেত্রে ঢিলেমি করে নরম ভাষায় সংশোধন করুন। প্রয়োজন হলে ধমক দিন, অতঃপর কঠোর ভাষায় সতর্ক করুন, যদি তাতে কাজ না হয় উত্তম-মাধ্যম করুন, তবে সালাতের জন্য দশ বছরের পূর্বে মারধর করা যথাযথ নয়।
একটি বিষয় স্মরণ রাখা জরুরি যে, মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তম-মাধ্যম বা শাসন বিলুপ্ত করার ঘোষণা অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল নিয়ে আসেনি, কারণ কতিপয় শিক্ষার্থী উত্তম-মাধ্যম ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা ব্যতীত তাদের বদ-অভ্যাস ত্যাগ করে না, এটা মনুষ্য স্বভাব। মারধর বিলুপ্ত করার পক্ষে অবস্থানকারীরা যত যুক্তি ও অজুহাত পেশ করুক তারা দূরদর্শী নয়। এতে সন্দেহ নেই যে, মারধর করার ক্ষেত্রে কতক শিক্ষক থেকে সীমালঙ্ঘন হয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে, তার অর্থ মারধর একেবারে বন্ধ করা নয়। ফকিহগণ বলেন, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কাউকে প্রহার করা বৈধ নয়, যার থেকে বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটে তাকে অবশ্যই তার জন্য জবাবদিহি করা উচিত।
“মাওসুয়াতুল ফিকহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ গ্রন্থে রয়েছে: “সকল আলেম একমত যে, বাচ্চারা যদি সালাত ও তাহারাত ত্যাগ করে এবং ফরজ শিখার ক্ষেত্রে শিথিলতা করে তাহলে অভিভাবকগণ তাদের শাসাবেন, সাত বছরের সময় কথার দ্বারা এবং দশ বছর পূর্ণ হলে প্রয়োজন সাপেক্ষে মারধর করবেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রعلموا الصبي الصلاة لسبع سنين , واضربوه عليها ابن عشر سنينগ্ধ.
“তোমরা বাচ্চাদের সালাত শিক্ষা দাও সাত বছরে এবং তার জন্য প্রহার কর যখন দশ বছর হয়”।
সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ডের ফতোয়া:
শিক্ষার্থীকে প্রহার করা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ডের প্রধান মুফতি বলেন: “আবু বকর রা. তার এক গোলামকে উট হারানোর কারণে মারধর করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কিছু বলেননি। শিক্ষক-শিক্ষিকা মনে রাখবেন, মারধর শিক্ষা দান করার এক উপকরণ ও শিক্ষার্থীর বক্রতা সোজা করার এক বৈধপন্থা, ক্রোধ ধমন কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার উদ্দেশ্যে মারধর করা বৈধ নয়। তাই একান্ত প্রয়োজনে প্রহার করার সময় লক্ষ্য রাখুন যেন ক্ষতি না হয়, শরীরে দাগ না কাটে, হাড্ডি না ভাঙ্গে, অঙ্গহানি না হয় ও ক্ষতের সৃষ্টি না হয়, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রلَا يُجْلَدُ أَحَدٌ فَوْقَ عَشَرَةِ أَسْوَاطٍ إِلَّا فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِগ্ধ.
“আল্লাহর হদ ব্যতীত দশটি বেত্রাঘাতের বেশী আঘাত করা যাবে না”। স্ত্রী অবাধ্য হলে প্রথমত উপদেশ প্রদান করুন, অতঃপর বিছানা পৃথক করুন, তাতে সংশোধন না হলে আল্লাহ মারধর করার অনুমতি প্রদান করেছেন, তবে তীব্র মারধর নয়। কারণ মারধর করার উদ্দেশ্য স্ত্রীর বক্রতা দূর করা, শক্তি প্রয়োগ ও প্রতিশোধ গ্রহণ করা নয়, শক্তি প্রয়োগ করা আদব শিক্ষা দেওয়ার সঠিক পন্থা নয়”।
শায়খ সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান বলেন, মারধর বাচ্চাদের শাসন করার বৈধ পদ্ধতি, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রمروا أولادكم بالصلاة لسبع واضربوهم عليها لعشرগ্ধ.
“সাত বছর হলে তোমরা তোমাদের সন্তানদের সালাতের নির্দেশ কর, এবং দশ বছর হলে তার জন্য প্রহার কর”। অনুরূপ স্ত্রী অবাধ্য হলে আল্লাহ তাকে শিষ্টাচার শিখানোর জন্য মারধর করার অনুমতি প্রদান করেছেন, তিনি বলেন:
﴿ وَٱلَّٰتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِي ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّۖ ٣٤ ﴾ [النساء : ٣٤]
“আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদের সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে প্রহার কর”। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রلَا يُجْلَدُ أَحَدٌ فَوْقَ عَشَرَةِ أَسْوَاطٍ إِلَّا فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِগ্ধ.
“আল্লাহর হদ ব্যতীত দশটি বেত্রাঘাতের বেশী কাউকে আঘাত করা যাবে না”।
মুয়াল্লিম ছাত্রকে এবং স্বামী স্ত্রীকে সংশোধন করার জন্য প্রয়োজন হলে মারধর করবেন। যারা প্রহারকে সংশোধন করার পদ্ধতি অস্বীকার করেন, তারা পাশ্চাত্যদের দ্বারা প্ররোচিত। তারা পাশ্চাত্যের আচরণ আমাদের দেশে আমদানি করতে চায়, কারণ তারা সেখান হতে শিক্ষিত এবং তাদের দ্বারা প্ররোচিত। পক্ষান্তরে আল্লাহ এবং তার রাসূল ও আদর্শ পূর্বপুরুষদের থেকে প্রমাণিত প্রহার সংশোধন করার একটি পদ্ধতি, তবে অবশ্যই সীমার ভেতর থাকা জরুরি, যেন তীব্র না হয়, চামড়া না ফাটে, হাড্ডি না ভাঙ্গে ও প্রয়োজন অতিরিক্ত না হয়”।
শায়খ ইবনে বায রহ. বলেন, “দশ বছর বয়স হলে সালাত ও বাড়ির কাজের জন্য অভিভাবকগণ সন্তানদের শাসন করবেন, প্রয়োজন হলে হালকা প্রহার করবেন, যেন কোনো ক্ষতি না হয় এবং উদ্দেশ্য হাসিল হয়”।
শায়খ মুহাম্মদ কুতুব বলেন, “মানুষকে আদব ও শিষ্টাচার শিখানোর জন্য শাস্তি প্রয়োগ করা স্বভাবগত বিষয়, বিশেষভাবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তাই বাচ্চাদের প্রতি দয়ার নামে তা অস্বীকার করা যায় না, কিংবা এ ক্ষেত্রে মুয়াল্লিমকে নিয়ন্ত্রণ করা যথাযথ নয়। বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা বলে, যে প্রজন্ম শাস্তি বিহীন ও শাস্তি নিষেধাজ্ঞার পরিবেশে বড় হয়, তারা অনেক ক্ষেত্রে অচেতন হয়, উন্নত জীবন গঠন ও কঠিন মুহূর্তে সামাজিক অবদান রাখতে তারা ব্যর্থ। অতএব অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। প্রহার না করার থিউরি যত মুখরোচক হোক, তা সবার জন্য কল্যাণকর নয়। শিক্ষার্থীদের উপর প্রকৃত দয়া হচ্ছে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য তাদেরকে যোগ্য করে তুলা, তাদের বিনষ্ট করার মাঝে কোনো দয়া নেই”।
প্রহার করার শর্তসমূহ
এতে সন্দেহ নেই যে, কতক শিক্ষার্থীকে মারধর ব্যতীত সংশোধন করা সম্ভব নয়, তবে তার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, যা রক্ষা করা হলে প্রহার সুফল বয়ে আনে এবং শিক্ষার্থীর জীবন বিচ্যুতি থেকে সংশোধনের পথে পরিচালিত হয়। নিম্নে মারধর করার কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করছি:
প্রথম শর্ত: পড়া-শুনায় অবহেলা কিংবা অসংলগ্ন আচরণের জন্য মুয়াল্লিম প্রথমধাপে শিক্ষার্থীকে প্রহার করবেন না, বরং প্রহার করার পূর্বের ধাপগুলো অনুসরণ করুন। ভুলগুলো স্মরণ করিয়ে দিন, বুঝান ও সংশোধন করুন, এতে কাজ না হলে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করুন, কিন্তু গালমন্দ ও খারাপ শব্দ প্রয়োগ করবেন না।
মুকাদ্দামাহ ইবনে খালদুনে বর্ণিত আছে, বাদশাহ হারুনুর রশিদ স্বীয় সন্তানের শিক্ষক মুহাম্মদ আমীনকে ওসিয়ত করেন, “প্রতিটা মুহূর্ত আপনি তাকে উপকৃত করার চেষ্টা করুন, তবে তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবেন না, তাহলে তার ব্রেন মেরে ফেলবেন। আর তাকে অধিক ছাড় দিবেন না, তাহলে সে অলসতাকে বেছে নিবে ও সময়ের অপব্যবহার করবে, যথাসম্ভব তাকে কাছে টেনে ও তার সাথে নম্র আচরণ করে তাকে সঠিক পথে রাখার চেষ্টা করুন, যদি সে এতে শুধরাতে না চায় তাহলে কঠোর হোন ও কঠোরতা করুন”।
দ্বিতীয় শর্ত: প্রহার করার জন্য শিক্ষার্থীর মাঝে আদব ও শিক্ষা কি জিনিস বুঝার জ্ঞান থাকা জরুরি, যারা বুঝে না তাদের মারধর করা বৈধ নয়। শিক্ষার্থীর বয়স ও অপরাধ উভয়ের প্রতি নজর রেখে শাস্তি প্রদান করা চাই, যেন কোনো ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন না হয়।
ছাত্রকে প্রহার করা সম্পর্কে ইমাম আহমদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন, “বাচ্চাদের অপরাধ অনুযায়ী প্রহার করা দোষণীয় নয়, তবে প্রহার করার পথ পরিহার করা ভালো, আর বাচ্চা অবুঝ হলে প্রহার করা বৈধ নয়”।
ফতোয়া বারজিলিতে রয়েছে, “শিক্ষার্থীরা কেউ হয় শক্তিশালী ও কেউ হয় দুর্বল, তাই তাদের অপরাধ ও শক্তি মোতাবিক প্রহার করা বাঞ্ছনীয়, কারণ সবার অপরাধ ও ধৈর্য ক্ষমতা সমান নয়”।
ইবনে হাজিব রহ. বাচ্চাদের মুয়াল্লিম সম্পর্কে বলেন, “যে সব বাচ্চা শরয়ী কারণ ব্যতীত স্বীয় দায়িত্বে অবহেলা করে, তাদের কারো জন্য শুধু চেহারার বিরক্তি প্রকাশ করা যথেষ্ট, কারো জন্য শক্ত কথা ও ধমকের প্রয়োজন হয়, আবার কাউকে প্রহার করা জরুরি হয়, প্রত্যেকের সাথে তাদের অবস্থা বুঝে ব্যবহার করা সমীচীন”।
তৃতীয় শর্ত: মুয়াল্লিম যদি মনে করেন প্রহার করলে সংশোধন হবে তাহলে প্রহার করবেন, অন্যথায় প্রহার করা বৈধ নয়। কারণ প্রহার করার উদ্দেশ্য সংশোধন করা, যদি সংশোধন না হয় তাহলে প্রহার করার কোনো অর্থ নেই।
চতুর্থ শর্ত: মুয়াল্লিম নিজে শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিবেন।
পঞ্চম শর্ত: গোস্বার সময় প্রহার না করা, কারণ তখন প্রহার করার উদ্দেশ্য সংশোধন না হয়ে গোস্বা নিবারণ করা হতে পারে।
ষষ্ঠ শর্ত: প্রহার করার সময় প্রহারের প্রকৃতি, পরিমাণ ও জায়গা ঠিক থাকা চাই। প্রকৃতি ঠিক থাকার অর্থ হালকা ও মৃদু প্রহার করা, পরিমাণ ঠিক থাকার অর্থ তিন বারের অধিক আঘাত না করা, জায়গা ঠিক থাকার অর্থ যেসব স্থানে প্রহার করা বৈধ নয় সেখানে প্রহার না করা, যেমন চেহারা, মাথা, বুক, পেট ও স্পর্শকাতর অঙ্গ। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
্রإِذَا قَاتَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَجْتَنِبِ الْوَجْهَগ্ধ.
“যখন তোমাদের কেউ আঘাত করে সে যেন চেহারায় আঘাত না করে”।
কখনো পরিবেশের কারণে শাস্তির ধরণ বিভিন্ন হয়, যেমন কোথাও কান ধরে দাঁড় করানো দোষণীয়, আবার কোথাও দোষণীয় নয়। তাই শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হলে অবশ্যই স্থানকাল পাত্র বিবেচনা করে রুচি সম্মত শাস্তি প্রদান করুন। প্রয়োজনে সহকর্মী, পরিচালক ও অন্যান্যদের সাথে শিক্ষার্থীর অপরাধ ও মুয়াল্লিমের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করুন।
সপ্তম শর্ত: হানাফি, মালিকি ও শাফিয়ি মাজহাবের অধিকাংশ ফকিহ বলেছেন বাচ্চাদের মারধর করার জন্য অভিভাবকের অনুমতি জরুরি। কারণ, শাস্তি প্রদান করা একটি শরয়ী বিধান, যা শাসক বা অভিভাবকের মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত। মুয়াল্লিম শাসক বা অভিভাবকের মর্যাদা সম্পন্ন নয়, তাদের প্রতিনিধি মাত্র, তাই তার শাস্তি প্রদান করার জন্য অভিভাবকের পূর্বানুমতি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য কাউকে প্রেরণ করার অর্থ মারধর করার অনুমতি প্রদান করা নয়, কারণ শিক্ষার সাথে তার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই। কতক অভিভাবক শিক্ষার অনুমতি দেন, কিন্তু মারধর করার অনুমতি দেন না, তাই তাদের চুপ থাকা সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি উভয় হতে পারে, অতএব স্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত প্রহার করা যাবে না”।
হাম্বলি ও মালিকি মাজহাবের সর্বশেষ ফতোয়া ও শাফিয়ি মাজহাবের কতক ফকিহ বলেন, “শিক্ষার্থীকে প্রহার করার জন্য অভিভাবকরে অনুমতির প্রয়োজন নেই, কারণ, শিক্ষার্থীকে প্রহার করার ক্ষেত্রে সবার মৌন সমর্থন রয়েছে”।
অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত শিক্ষার্থীকে প্রহার করা বৈধ এ কথাই সঠিক। কারণ মুয়াল্লিমের প্রহার করার বিষয়টি সমাজে প্রচলিত, তার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয়ত অপরাধের জন্য শিক্ষার্থীকে প্রহার করা অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে হলে অন্যদের মাঝে ইনসাফ করা সম্ভব নয়। তখন মুয়াল্লিম অনুমতির ভিত্তিতে কাউকে মারবে, কাউকে মারবে না, এরূপ আচরণ এক প্রতিষ্ঠানে কল্যাণকর নয়।
যেসব প্রতিষ্ঠানে মারধর করা নিষেধ, সেখানে কাউকে ভর্তি করার অর্থ তাকে মারধর করার অনুমতি নেই। আর যেখানে মারধর করা নিষেধ নয়, সেখানে কাউকে ভর্তি করার অর্থ হচ্ছে সমাজের রীতি মোতাবেক প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রহার করা বৈধ।
অপরাধের শ্রেণীভাগ
শিক্ষার্থীদের অপরাধগুলো দু’প্রকার: ১. অপরাধের অনিষ্ট ও প্রভাব খোদ শিক্ষার্থীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে, তার দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, যেমন ক্লাসে অমনোযোগী থাকা বা ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা বা ক্লাসের পড়া যথারীতি সম্পন্ন না করা ইত্যাদি। এ জাতীয় অপরাধ গৌণ, তার জন্য শাস্তি কম হবে। এ সমস্যার জন্য অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করা ও তাদেরকে বিষয়গুলো জানিয়ে রাখা জরুরি। মুয়াল্লিম লক্ষ্য রাখবেন, কারো প্রতি বেশী যতœশীল হতে গিয়ে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের আমানত নষ্ট করা যাবে না।
২. শিক্ষার্থীর অপরাধের কারণে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন অন্যকে পড়তে না দেওয়া, কিংবা কারো শরীরে আঘাত করা বা ক্লাসে অস্বাভাবিক আচরণ করা, যার দ্বারা অন্যদের মনোযোগ ও পড়াশুনার পরিবেশ নষ্ট হয়। এ জাতীয় অপরাধ কোনো শিক্ষার্থী থেকে প্রথমবার সংগঠিত হলে খোদ মুয়াল্লিম সংশোধন করার চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে পরিচালক বা দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করুন। দ্বিতীয় বার সংগঠিত হলে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল, প্রয়োজনে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করুন, তারা আপনাকে অনেক সমাধান বলে দিবেন, বিশেষ করে অভিভাবকগণ।
এ জাতীয় অপরাধ যদি ক্লাসে বারবার সংগঠিত হয়, কিংবা তার দ্বারা পড়াশুনার পরিবেশ নষ্ট হয়, কিংবা অপরাধের প্রকৃতি মারাত্মক হয়, তাহলে দায়িত্বশীলদের তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে বলুন, কোনো কারণে বিলম্ব হলে দুষ্ট ছাত্রকে ক্লাসের বাইরে কিংবা অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন, যেন অন্য ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর এ জাতীয় অপরাধ যদি ক্লাসের বাইরে সংগঠিত হয় তাহলে তার শাস্তি প্রদান থেকে মুয়াল্লিমের বিরত রাখা নিরাপদ। ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের উপর তার বিচার ভার ছেড়ে দিন।
শিক্ষক শিক্ষার্থীকে গবেষণা করুন, তার স্বভাব, মানসিকতা ও শারীরিক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করুন, তার অপরাধ সম্পর্কে অভিভাবকের সাথে আলোচনা করুন, তারা আপনাকে শিক্ষার্থী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও সমাধানের পথ বাতলে দিবেন। কারণ কোনো শিক্ষার্থীর মাঝে কঠিন রোগ বা স্পর্শ কাতর অপারেশন থাকতে পারে, তখন সামান্য আঘাত বড় বিপদ ডেকে আনবে, তাই অপরাধ যত বড় হোক তাড়াহুড়ো পরিত্যাগ করুন। কারণ ক্ষমা করে ভুল করা ভালো, কিন্তু শাস্তি দিয়ে ভুল করা ভালো নয়।

হাফেজি ক্লাসের পরিচিতি

হিফয বিভাগ  বা শ্রেণির  পরিচিতি
হিফয বিভাগের ছাত্র/ ছাত্রীর অর্থ সবার হিফয পড়া জরুরি নয়, বরং হিফযের উদ্দেশ্যে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে হিফয শাখার ছাত্র-ছাত্রী বলা হয়। সাধারণত প্রত্যেক হিফয শাখায় তিন প্রকার ছাত্র/ ছাত্রী থাকে: ক. হিফয গ্রুপ, খ. নাজেরা গ্রুপ, গ. নুরানী বা কায়েদা গ্রুপ। নিম্নে প্রত্যেক গ্রুপের পরিচয় পেশ করছি:
নুরানী বা কায়েদা গ্রুপ: নুরানী বা কায়েদা গ্রুপের ছাত্র/ ছাত্রীরা আরবি হরফ, হরকত, শব্দ ও বাক্য পড়তে শিখে। মুয়াল্লিম ‘কায়েদা গ্রুপে’র জন্য সর্বপ্রথম একটি ভালো কায়েদা বেছে নিন। অতঃপর কায়েদা থেকে তাদেরকে আরবি হরফের পরিচয় ও তার বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা দিন। প্রতিটি হরফের স্থানভেদে বিভিন্ন আকৃতি ও গঠনের পরিচয় প্রদান করুন। কালিমার শুরুতে, মধ্যবর্তী ও শেষ অবস্থার ভিত্তিতে কোনো হরফের দু’টি, কোনো হরফের চারটি আকৃতি হয়, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তা আত্মস্থ করতে সাহায্য করুন। আরবি হরফ জানা শেষে প্রথম হরকত, অতঃপর ধীরেধীরে কায়েদার ধারাক্রম মোতাবেক শব্দ ও বাক্য শিক্ষা দিন।
তাজবিদের নিয়ম-কানুন শিখানোর চাইতে তাজবিদের সঠিক প্রয়োগ শিক্ষা দিন। ছাত্র/ ছাত্রী যদি ছোট ও প্রাথমিক অবস্থার হয়, তাদেরকে তাজবিদের নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে বুঝানো ঠিক নয়, আপনি বিশুদ্ধ উচ্চারণ করে তালিম দিন, আপনার উচ্চারণ থেকে তারা মাদ-গুন্না, ইযহার, ইদগাম ও ইকলাবের সঠিক প্রয়োগ শিখবে। উদাহরণের মাধ্যমে শিক্ষা দিন, যেমন কোনো শব্দে নুন সাকিন বা তানবীনের পর ‘বা’ হরফ থাকায় তাকে ইকলাবের উচ্চারণ শিখিয়েছেন। এ উদাহরণটি মুয়াল্লিম হিসেবে আপনি মনে রাখুন এবং শিক্ষার্থীকে এরূপ দু’চারটি উদাহরণ খুঁজে বের করতে বলুন। তাকে বলে দিন এরূপ হলে এভাবে উচ্চারণ করতে হয়। দ্বিতীয়বার যখন এ শব্দটি আসবে তাকে সঠিক উচ্চারণ করতে বলুন, ভুল হলে কায়দায় বিদ্যমান প্রথম শব্দটি খুঁজে দিন এবং সেখান থেকে উচ্চারণ শুদ্ধ করুন।
এভাবে ছোট-বাচ্চাদের নিয়ে সামনে অগ্রসর হলে তাজবিদের নিয়ম-কানুন মুখস্থ করার বাড়তি চাপ অনুভব করার পূর্বে তারা তাজবিদ শিখবে সন্দেহ নেই। কতক কায়দায় তাজবিদের নিয়মানুসারে হরফগুলো বিভিন্ন রং করা থাকে, বাচ্চাদের জন্য তা অধিক সহজ। আপনার প্রচেষ্টা ও শিক্ষার্থীর ধারাবাহিকতা পরস্পর সঙ্গী হলে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে কায়েদা শেষ হবে, ইনশাআল্লাহ।
বিশুদ্ধ কায়েদা: আমাদের দেশীয় ‘নুরানী কায়েদা’-তে আরবি হরফের সঠিক সংখ্যা ও বিন্যাস যথাযথ নয়। আরবি হরফ ২৮-টি এবং বিন্যাস নিম্নরূপ:
خ ح ج ث ت ب أ
ص ش س ز ر ذ د
ق ف غ ع ظ ط ض
ي و ه ن م ل ك
উর্দু-ফারসির সংমিশ্রণের ফলে আমাদের দেশে আরবি হরফগুলো তার স্বতন্ত্র হারিয়েছে। সৌদি আরব থেকে প্রিণ্টকৃত নুর মুহাম্মদ হক্কানী সাহেবের নুরানী কায়দাতেও আরবি হরফের সংখ্যা ও বিন্যাস ঠিক নেই, সেখানে আরবি হরফ ৩০টি রয়েছে, অন্যান্য কায়দায় সাধারণত ২৯-টি বিদ্যমান । বস্তুত আরবি হরফ ২৮টি।
জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে হামযাহ ও আলিফ থেকে। এ দু’টি হরফকে মূল হরফ গণনা করায় হরফ সংখ্যা ২৯টি হয়েছে, অথচ আলিফ মূল হরফ নয়। আলিফ হচ্ছে দীর্ঘ স্বর, যা ফাতহার (জবর) সাথে উচ্চারণ হয়। ফাতহার পর আলিফ হলে ফাতহার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়, আলিফ না হলে ফাতহার উচ্চারণ হ্রস্ব স্বর হয়। অথবা বলুন, আলিফ হচ্ছে মাদের (দীর্ঘ স্বরের) হরফ। আরবিতে মাদের হরফ তিনটি: ‘আলিফ’, ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’। ‘দাম্মা’র পর মাদের হরফ ‘ওয়া’ হলে দাম্মার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়; কাসরার পর মাদের হরফ ‘ইয়া’ হলে কাসরার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়; ফাতহার পর মাদের হরফ আলিফ হলে ফাতহার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়। দাম্মা, কাসরা ও ফাতহার পর মাদের হরফ ‘আলিফ’, ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’ না হলে তাদের উচ্চারণ হ্রস্ব স্বর হয়।
উল্লেখ্য, ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’ মূল বা স্বতন্ত্র হরফ হিসেবেও ব্যবহার হয়। অতএব ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’র দু’টি মান: মূল হরফের মান ও হরফে ইল্লতের মান। তাই ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’তে যদি দাম্মাহ, ফাতহা ও কাসরা হয় এবং তার পরে যদি মাদের হরফ না হয়, তাহলে তার উচ্চারণ হবে অন্যান্য হরফের ন্যায় হ্রস্ব স্বর। যদি তার পরে মাদের হরফ হিসেবে ‘ওয়া’, ‘ইয়া’ কিংবা আলিফ হয়, তাহলে তার উচ্চারণ হবে দীর্ঘ স্বর। আলিফ শুধু মদের হরফ হিসেবে উচ্চারণ হয়। তাই তার উপর হরকত শুদ্ধ নয়, কিংবা আলিফের উপর হরকত হলে তা আলিফ থাকে না, হামযাহ হয়ে যায়।
আরবি পরিভাষা ব্যবহার করুন: জের, জবর ও পেশ ফারসি পরিভাষার পরবর্তীতে আরবি পরিভাষা দাম্মাহ, ফাতহা, কাসরা, সুকুন ও শাদ্দাহ ব্যবহার করুন। বানান পদ্ধতি প্রয়োজনে কারো থেকে শিখে নিন, তবুও বাচ্চাদেরকে আরবি পরিভাষা দ্বারা কুরআনুল কারিম শিক্ষা দিন।
নাজেরা গ্রুপ: কায়েদা শেষ করে ছাত্র/ ছাত্রীরা নাজেরা গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। দেখে-দেখে কুরআনুল কারিম দ্রুত ও শুদ্ধভাবে পড়তে শিখাকে নাজেরা বলা হয়। নাজেরা পড়ুয়া ছাত্র/ ছাত্রীদের প্রতি মুয়াল্লিম অধিক যতœ নিন, যেন যথাযথভাবে তারা তাজবিদের ব্যবহার ও তার সঠিক প্রয়োগ শিখে। শুরুতে তাদের কয়েকটি সূরা মুখস্থ করিয়ে নিন; যেমন সূরা ফাতিহা, নাস, ফালাক ও ইখলাস থেকে সূরা ফীল বা তাকাসুর পর্যন্ত সূরাসমূহ। অতঃপর ত্রিশতম পারা নাজেরা পড়ান। ত্রিশতম পারার নাজেরা শেষে মুয়াল্লিম সিদ্ধান্ত নিবেন ছাত্র/ ছাত্রী হিফয পড়বে-না আরো কয়েক পারা নাজেরা পড়বে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে তাদের ইচ্ছা ও রুচি জেনে নিন। যদি ছাত্র/ ছাত্রীর চাওয়া ও মুয়াল্লিমের অভিজ্ঞতা এক হয় খুব ভালো, অন্যথায় মুয়াল্লিমের অভিজ্ঞতার দাবি তাদেরকে বুঝিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বলুন।
হিফয পড়ার উপযুক্ত কোনো ছাত্র/ ছাত্রী নাজেরাহ পড়তে চাইলে বলুন, নাজেরাহ পড়ার অর্থ সময় নষ্ট করা ও পিছিয়ে পড়া; কয়েক পড়া হিফয করলে তোমার তিলাওয়াতের ধীরগতি দূর হয়ে যাবে এবং যে কোনো স্থান থেকে তুমি বিনা জড়তায় পড়তে পারবে। অনুরূপ নাজেরা পড়ার উপযুক্ত কোনো ছাত্র/ ছাত্রী হিফয পড়তে চাইলে বলুন, নাজেরা দ্রুত না হলে হিফয গতিশীল হয় না। অতএব তোমার জন্য নাজেরা উত্তম।
নাজেরা পড়ার উপযুক্ত কোনো ছাত্র/ ছাত্রী হিফয পড়তে আগ্রহী হলে তাকে হিফয পড়ার সুযোগ দিন, তার হিম্মতকে ধন্যবাদ জানান ও তাকে সাহায্য করুন যেন প্রতি পৃষ্ঠা হিফয করার পূর্বে নাজেরা বিশুদ্ধ ও তিলাওয়াত গতিশীল করে নেয়।
এভাবে ছাত্র-শিক্ষকের গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অবশ্যই অভিভাবককে অবহিত করুন, সন্তান বা প্রিয় পোষ্যের ইতিবাচক দিকগুলো অভিভাবকের সামনে তুলে ধরুন। অভিভাবক হাফেয বা গায়রে-হাফেয, পড়ুয়া বা আনপড় যে কেউ হোক তাকে কোনো তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করা ঠিক নয়।
আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত, ছয়/ সাত বছরের একজন ছাত্র/ ছাত্রী চার থেকে পাঁচ বা ছয় মাস কায়েদা ও অবশিষ্ট ছয় মাস নাজেরা পড়ার পর দ্বিতীয় বছর হিফযের উপযোগী হয়, তবে মেধা ও মনোযোগিতার তারতম্যের কারণে কম-বেশী হওয়া স্বাভাবিক।
হিফয গ্রুপ: হিফয বিভাগের শিক্ষার্থীরা নাজেরা সমাপ্ত করে হিফয গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী কায়েদাহ সমাপ্ত করে নাজেরা গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। অতঃপর ছয় মাস নাজেরা পড়ার পর হিফয গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। সাধারণত কায়েদা ও নাজেরা গ্রুপে এক বছরের বেশী সময়ের প্রয়োজন হয় না। একজন শিক্ষার্থী যখন হিফযের উপযোগী হয়, তখন সে তাজবিদসহ কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার যোগ্যতা অর্জন করে। অর্থাৎ সে আরবি হরফের বিশুদ্ধ উচ্চারণ, মাদ ও গুন্নাসহ বিনা জড়তায় কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করতে সক্ষম হয়। কোথাও সামান্য জড়তা থাকলে ১/২ পড়ার ফলে তা দূর হয়ে যায়।
হিফয গ্রুপে উত্তীর্ণ ছাত্র/ছাত্রীরা নাজেরা গ্রুপে থাকাবস্থায় সূরা ফীল থেকে সূরা নাস, কিংবা তার চেয়ে অধিক সংখ্যক সূরা মুখস্থ করেছে। অতএব এখন সে হুমাযাহ বা তার পরবর্তী মুখস্থ সূরার পর থেকে হিফয আরম্ভ করবে। প্রথম ত্রিশ, ঊনত্রিশ ও আটাশতম পারাসমূহ মুখস্থ করা ভালো, ইচ্ছা হলে ৫ থেকে ১০ পারাও মুখস্থ করা যায়। আবার সূরা বাকারা থেকে মুখস্থ শুরু করা কোনো সমস্যা নেই।

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার পূর্বে করণীয়

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার নিয়ত
কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার জন্য কোনো নিয়তের প্রয়োজন নেই, তবে নির্দিষ্ট নিয়ত থাকা ভালো। কারণ নিয়তসহ কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা তাতে চিন্তা করা ও তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার শামিল, যার প্রতি শরীয়তের নির্দেশ রয়েছে। মালিক আশজায়ি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
্রقُمْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً ” فَقَامَ فَقَرَأَ سُورَةَ الْبَقَرَةِ لَا يَمُرُّ بِآيَةِ رَحْمَةٍ إِلَّا وَقَفَ فَسَأَلَ، وَلَا يَمُرُّ بِآيَةِ عَذَابٍ إِلَّا وَقَفَ فَتَعَوَّذَগ্ধ.
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একরাত কিয়াম করেছি, তিনি দাঁড়ালেন ও সূরা বাকারা পড়লেন। তিনি রহমতের কোনো আয়াত অতিক্রম করতেন না, তবে অবশ্যই বিরতি নিতেন ও প্রার্থনা করতেন। এবং শাস্তির কোনো আয়াত অতিক্রম করতেন না, তবে অবশ্যই বিরতি নিতেন ও আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।”
এ হাদিস বলে, তিলাওয়াতের সময় কুরআনুল কারিমের অর্থ ও বিষয়-বস্তুতে চিন্তা করা, তার রঙে রঙিন হওয়া, দোয়ার জায়গায় দোয়া করা ও শাস্তির জায়গায় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত, তার উপর আমল করার জন্য অবশ্যই নিয়তসহ তিলাওয়াত করা জরুরি। বিশেষ কোনো নিয়তসহ যখন তিলাওয়াত করা হয়, তখন প্রতি আয়াত পড়ার সময় তার দিকে হৃদয় ধাবিত হয় এবং তাতে কিছু সময় চিন্তা করার জন্য হৃদয় প্রস্তুত থাকে। তাই নিম্নে তিলাওয়াত করার কতিপয় নিয়ত উল্লেখ করছি:
১. হিদায়েত ও ইলম হাসিল করার নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“রমদান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়েত স্বরূপ এবং হিদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী স্বরূপ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”।
২. আমল করার নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ ٣ ﴾ [الاعراف: ٣]
“তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না”।
৩. ঈমান বৃদ্ধির নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ فَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمۡ زَادَتۡهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنٗاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَزَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا ١٢٤﴾ [التوبة:১২৪]
“আর যখনই কোন সূরা নাযিল করা হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, ‘এটি তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অতএব যারা মুমিন, নিশ্চয় তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে”।
৪. আল্লাহ তা‘আলাকে শুনানোর নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। সহি হাদিসে এসেছে:
্রمَا أَذِنَ اللَّهُ لِشَيْءٍ، مَا أَذِنَ لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ গ্ধ.
“আল্লাহ কোনো বস্তু এভাবে শ্রবণ করেননি, যেভাবে কুরআনের ক্ষেত্রে সুন্দর আওয়াজ সম্পন্ন নবীর জন্য শ্রবণ করেছেন, যিনি উচ্চ স্বরে কুরআন মাজিদ পড়েন।”
৫. শরীর ও আত্মার রোগ থেকে মুক্তি এবং ঝাড়-ফুঁক করার নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ ﴾ [يونس : ٥٧]
“হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়েত ও রহমত”।
৬. কিয়ামতের দিন উঁচু মর্যাদা লাভ করার নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗاۖ وَكَانُواْ لَنَا خَٰشِعِينَ ٩٠ ﴾ [الانبياء: ٩٠]
“নিশ্চয় তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, আর আমাকে আশা ও ভীতিসহ ডাকত, আর তারা ছিল আমার নিকট বিনয়ী”।
৭. সাওয়াব লাভ করার নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রأَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ، أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِيَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ، فِي غَيْرِ إِثْمٍ، وَلَا قَطْعِ رَحِمٍ؟ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، نُحِبُّ ذَلِكَ، قَالَ: ” أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ، أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ এ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ؟ গ্ধ.
“তোমাদের থেকে কে পছন্দ করে প্রতিদিন বুতহান অথবা আকিক স্থানে যাবে, অতঃপর সেখান থেকে উঁচু কুজ বিশিষ্ট দু’টি উট নিয়ে আসবে, অপরাধ সংগঠন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ব্যতীত? আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তা পছন্দ করি। তিনি বললেন: তাহলে কেন তোমাদের কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাব থেকে দু’টি আয়াত শিখে না, অথবা তিলাওয়াত করে না, যা তার জন্য দু’টি উট থেকে উত্তম, তিনটি আয়াত তিনটি উট থেকে উত্তম, চারটি আয়াত চারটি উট থেকে উত্তম, অনুরূপ আয়াতের সংখ্যা উটের সংখ্যা থেকে উত্তম”।
৮. কিয়ামতের দিন কুরআনুল কারিমের সুপারিশ লাভ করার নিয়তে তিলাওয়াত করা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রاقْرَءُوا الْقُرْآنَ، فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ، اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ وَسُورَةَ آلِ عِمْرَانَ فَإِنَّهُمَا تَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ، أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ، أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ أَصْحَابِهِمَا، اقْرَءُوا سُورَةَ الْبَقَرَةِ فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ، وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ، وَلَا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُগ্ধ
“তোমরা কুরআন পড়, কারণ কিয়ামতের দিন কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হবে। তোমরা দু’টি উজ্জ্বল বস্তু শিখ: সূরা বাকারা ও সূরা আলে-ইমরান, কারণ কিয়ামতের দিন সূরা দু’টি আসবে, যেন তারা দু’টি মেঘ, অথবা যেন তারা দু’টি ছায়া, অথবা যেন তারা সারিবদ্ধ পাখিদের দু’টি ডানা, তারা উভয়ে তাদের পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে, তোমরা সূরা বাকারা পড়, কারণ তা শিক্ষা করা বরকত ও ত্যাগ করা অনুশোচনা, কোনো যাদুকর তা শিখতে সক্ষম নয়”।
৯. আল্লাহর রহমত লাভ করার নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿هَٰذَا بَصَآئِرُ مِن رَّبِّكُمۡ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٢٠٣ ﴾ [الاعراف: ٢٠٢]
“এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ। আর তা হিদায়েত ও রহমত সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে”।
১০. কুরআনুল কারিম শ্রবণ করার সময় আল্লাহর রহমত লাভ করার নিয়ত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤﴾ [الاعراف: ٢٠٣]
“আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর”।
হে আল্লাহ আপনি আমাদের উপর রহম করুন, যেন আপনার রহমতের পর কারো রহমতের প্রয়োজন না হয়, আপনি বলেছেন:
﴿ لَمَغۡفِرَةٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَحۡمَةٌ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ١٥٧ ﴾ [ال عمران: ١٥٧]
“নিশ্চয় আল্লাহর মাগফেরাত ও রহমত অধিকতর উত্তম, তোমরা যা জমা কর তার চেয়ে”।

কুরানুল কারিম শিক্ষাদান কারীর কী কী গুণ থাকা দরকার

কুরআনুল কারিম শিক্ষাদানকারীর আদব
আল্লাহ তা‘আলা যেরূপ কুরআন নাযিল করেছেন, অনুরূপ তা শিক্ষা দেওয়ার কতিপয় আদব নাযিল করেছেন, যা প্রত্যেক মুয়াল্লিমের জানা জরুরি। কারণ, আদব হচ্ছে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যকার বন্ধন ও যোগসূত্র। আদব যেরূপ গভীর ও অকপট হয়, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সেরূপ দৃঢ় ও মজবুত হয়। আদব সুন্দর হলে শিক্ষার আদান-প্রদান সুন্দর, ব্যাপক ও বরকতময় হয়। তাই নিম্নে মুয়াল্লিমের কতিপয় আদব উল্লেখ করছি:
১. কুরআনুল কারিমকে আদর্শ বানানো: কুরআনুল কারিমের শিক্ষক সর্বপ্রথম নিজেকে কুরআনুল কারিমের আখলাক দ্বারা সজ্জিত করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ ١٢١ ﴾ [البقرة: ١٢١]
“আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে”।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, তারা যথাযথভাবে কুরআনুল কারিম অনুসরণ করে”। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়ে ছিল, তিনি বলেন:
্রكَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَগ্ধ.
“তার আখলাক ছিল কুরআন”। অতএব নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ন্যায় কুরআনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা তার উত্তরসূরির প্রথম কাজ।
২. উপযুক্ত জায়গায় তালিম দেওয়া: কুরআনুল কারিম শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করা জরুরি। শিক্ষার্থীর সাথে সম্পৃক্ত বা তার মালিকানাধীন জায়গায় তালিম না দেওয়া, শাসক কিংবা ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে পাঠদান থেকে বিরত থাকা শ্রেয়। আমাদের আদর্শ পূর্বপুরুষগণ শিক্ষার্থীর সাথে সম্পৃক্ত জায়গায় বসে দীনি শিক্ষা প্রদান করেননি। এটা অহংকার নয়, বরং ইলমের মর্যাদার সুরক্ষা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রلَا يَنْبَغِي لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يُذِلَّ نَفْسَهُগ্ধ.
“নিজেকে অসম্মান করা কোনো মুমিনের পক্ষে সমীচীন নয়”। অপর হাদিসে তিনি বলেন:
্রخَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ গ্ধ.
“তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি যে-কুরআন শিখে ও তা শিখায়”।
৩. শিক্ষার্থীর প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ প্রদান করা: শিক্ষার্থীর প্রতি মুয়াল্লিমের পূর্ণ মনোনিবেশ করা, তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার খবরাখবর নেওয়া শিক্ষকের বিশেষ গুণ। পাঠদানের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কথা বা কাজে মগ্ন না হওয়া, পরিপূর্ণ মনোযোগসহ সবার তিলাওয়াত শ্রবণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤﴾ [الاعراف: ٢٠٣]
“যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তোমরা মনোযোগসহ শ্রবণ কর ও তার জন্য চুপ থাক, তাহলে তোমাদের উপর রহম করা হবে”।
৪. শিক্ষার্থীদের মাঝে ইনসাফ ও সমতা বজায় রাখা: ছোট-বড়, ধনী-গরীব সবার ক্ষেত্রে ইনসাফ বজায় রাখা, প্রত্যেককে তাদের অধিকার পাইয়ে দেওয়া। কুরআন শিক্ষাদানকারীর পক্ষে সমীচীন নয় ধনীকে কাছে নেওয়া, গরীবকে দূরে ঠেলে দেওয়া, ধনীর জন্য বিনয়ী হওয়া ও গরীবের জন্য কঠোর হওয়া। উপযুক্ত কারণ ব্যতীত কাউকে কারো উপর প্রাধান্য না দেওয়া। কাউকে সম্বোধন করে কাউকে পরিত্যাগ না করা, সবার প্রতি সমান দৃষ্টি ও সমান মনোযোগ প্রদান করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ بِٱلۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلَّهِ ١٣٥ ﴾ [النساء : ١٣٥]
“হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে”।
৫. ধৈর্যধারণ করা: কারো থেকে ভুল বা অসংলগ্নতা প্রকাশ পেলে ধৈর্যধারণ করা, তিরস্কার ও অসম্মান না করা। শিক্ষার্থীদের ঘনিষ্ঠ হওয়া, তারা যেন মুয়াল্লিমকে পেয়ে খুশি হয়। বেশী রূঢ় বা বেশী শিথিল না হওয়া, বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রإِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِগ্ধ. وفي رواية لمسلم: ্রإِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُগ্ধ.
“নিশ্চয় আল্লাহ সহনশীল, সহনশীলতা পছন্দ করেন এবং তিনি সহনশীলতার বিনিময়ে যা প্রদান করেন, তা কখনো কঠোরতার বিনিময়ে প্রদান করেন না”। মুসলিমের এক বর্ণনা রয়েছে: “কোনো বস্তুতে নম্রতা অবস্থান করে না, তবে অবশ্যই নম্রতা ঐ বস্তুকে সুন্দর করে এবং কোনো বস্তু হতে নম্রতা অপসারণ করা হয় না, তবে অবশ্যই নম্রতার অনুপস্থিতি ঐ বস্তুকে বিনষ্ট করে”। আইয়ুব সাখতিয়ানী রহ. বলেন: “আলেমের উচিত আল্লাহর প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিজের মাথার উপর মাটি রাখা”।
৬. শিক্ষার্থীদের কল্যাণ কামনা করা: কুরআন পড়তে আসা শিক্ষার্থীকে স্বাগত জানানো ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করা বিশেষ এক আদব। আবু হারুন আবাদি রহ. বলেন, আমরা আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট আসতাম, তিনি বলতেন, তোমাদেরকে স্বাগতম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের জন্য কল্যাণ কামনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
্রإِنَّ النَّاسَ لَكُمْ تَبَعٌ وَإِنَّ رِجَالًا يَأْتُونَكُمْ مِنْ أَقْطَارِ الْأَرَضِينَ يَتَفَقَّهُونَ فِي الدِّينِ فَإِذَا أَتَوْكُمْ فَاسْتَوْصُوا بِهِمْ خَيْرًاগ্ধ.
“নিশ্চয় মানুষেরা তোমাদের অনুসারী, আর নিশ্চয় দীন শিখার জন্য মানুষেরা দুনিয়ার দিগন্ত থেকে তোমাদের নিকট আসবে, যখন তারা তোমাদের নিকট আসবে তোমরা তাদের কল্যাণ কামনা কর”। অপর হাদিসে তিনি বলেন:
্রالدِّينُ النَّصِيحَةُ، قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ: لِلَّهِ، وَلِكِتَابِهِ، وَلِرَسُولِهِ، وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ، وَعَامَّتِهِمْগ্ধ.
“নিশ্চয় দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা, আমরা বললাম: কার জন্য? তিনি বললেন: আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রাসূলের জন্য ও মুসলিমদের ইমামদের জন্য ও তাদের সর্বসাধারণের জন্য”। অতএব কুরআনুল কারিমের শিক্ষার্থীদের সাথে কল্যাণ কামনা করা কুরআনুল কারিমের সাথে কল্যাণ কামনা করার অংশ।
আহলে-ইলমগণ বলেন, কোনো শিক্ষার্থীর নিয়ত অশুদ্ধ প্রমাণিত হলে তাকে ইলমে-দীন শিখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা তার প্রতি অনুগ্রহ করার শামিল। সুফইয়ান রহ. বলেন: “ইলম শিক্ষার পিছনে সবার নিয়ত থাকে, আমরা গায়রুল্লার জন্য ইলম শিখে ছিলাম, কিন্তু ইলম গায়রুল্লাহর জন্য হতে অস্বীকার করেছে”।
৭. শিক্ষার্থীদের উপদেশ দেওয়া: শিক্ষার্থীদের কুরআনুল কারিমের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা, সময়-সুযোগ বুঝে হাফিযদের মর্যাদার কথা আলোচনা করা, হিফয করার উপকারিতা, তিলাওয়াত করার আদব আলোচনা করা এবং দুনিয়া সংগ্রহ ও তাতে মগ্ন হওয়া থেকে সতর্ক করা আদর্শ শিক্ষকের এক বিশেষ গুণ।
৮. আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করা: কুরআনুল কারিমের মুয়াল্লিমের পক্ষে সমীচীন নয় স্বীয় প্রয়োজন মানুষের নিকট পেশ করা। তিনি সকল প্রয়োজন আল্লাহর নিকট পেশ করবেন এবং সম্পদশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকবেন। চেষ্টা করবেন যেন মানুষের প্রয়োজন তার মাঝে সৃষ্টি হয়, মানুষ যেন দীনের জন্য তার মুখাপেক্ষী হয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রمَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ تعالى لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِগ্ধ.
“যে এমন ইলম শিখল, যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়, অথচ সে তা শিখেছে একমাত্র দুনিয়ার সম্পদ অর্জন করার জন্য, কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না”।
অতএব কুরআনুল কারিমের মুয়াল্লিমগণ স্বীয় প্রতিদান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, যেমন নবী-রাসূলগণ করতেন। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَآ أَسۡ‍َٔلُكُمۡ عَلَيۡهِ مِنۡ أَجۡرٍۖ إِنۡ أَجۡرِيَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٠٩ ﴾ [الشعراء : ١٠٩]
“আর আমি তার (দীন শিখানোর) উপর তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না, আমার পারিশ্রমিক শুধু সৃষ্টিকুলের রবের নিকট”।
৯. কুরআনুল কারিমের মুয়াল্লিমের আরো কতিপয় গুণ: দানশীল ও উদার হওয়া, আল্লাহ তাকে প্রদান করলে মানুষকে প্রদান করা, তার উপর সংকীর্ণ করা হলে বিরত থাকা। দুনিয়ার মোহ ও তার সামগ্রীর সাথে সম্পৃক্ত না হওয়া। পিতা-মাতার খিদমত করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা। সাথীদের কল্যাণ কামনা করা, দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও গাম্ভীর্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া, অধিক হাসি-ঠাট্টা থেকে বিরত থাকা।
কথা বলার প্রয়োজন হলে বলা, অন্যথায় চুপ থাকা। অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করা। জিহ্বার অনিষ্ট থেকে নাজাতের জন্য শত্রুর মত তাকে ভয় করা, শত্রুকে বন্ধী রাখার মত তাকে বন্ধী রাখা।
নিজের প্রশংসা না করা, নফস থেকে সতর্ক থাকা, গীবত পরিহার করা, কাউকে খাটো না করা, কারো মুসিবত দেখে খুশি না হওয়া, কারো উপর সীমালঙ্ঘন না করা, কারো সাথে হিংসা না করা, প্রমাণ ব্যতীত কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করা। নিষিদ্ধ বস্তু হতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিফাজত করা। মুখ ও হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়া, কারো উপর জুলম না করা, জুলমের শিকার হলে সম্মানজনকভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, অন্যথায় ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহকে সন্তুষ্ট ও শত্রুকে রাগান্বিত করার জন্য গোস্বাকে হজম করা। সত্য যার পক্ষ থেকে প্রকাশ হোক গ্রহণ করতে বিলম্ব না করা।
অর্থ উপার্জন করার নিম্নমানের পেশা ও পদ্ধতি পরিহার করা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা, শরীর দূর গন্ধ মুক্ত রাখা, দাঁড়ি ছেড়ে দেওয়া ও মোচ ছোট করা।
১০. শিক্ষার্থীদের মহব্বত করা: শিক্ষার্থীদের মহব্বত করা ও তাদের রুচি-সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখা, স্বীয় নফস ও নিজ সন্তানের ন্যায় তাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করা, নিজ সন্তানের দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণ সহ্য করার ন্যায় তাদের অসদাচরণ সহ্য করা আদর্শ শিক্ষকের বিশেষ গুণ। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
্রأكرم الناس علي جليسي الذي يتخطى الناس حتى يجلس إلي لو استطعت أن لا يقع الذباب على وجهه لفعلت ، وفي رواية إن الذباب ليقع عليه فيؤذينيগ্ধ.
“আমার নিকট আমার সে ছাত্র বেশী প্রিয়, যে মানুষদের ডিঙ্গিয়ে আমার নিকট বসে, যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত তার চেহারায় কোনো মাছি বসবে না, আমি তাই করতাম”। অপর বর্ণনায় রয়েছে: “তার উপর মাছি বসে, তাও আমাকে কষ্ট দেয়”।

কুরআনুল কারিম হিফয করার গুরুত্ব

কুরআনুল কারিম হিফয করার গুরুত্ব
মুসলিম উম্মাহর বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার কালাম হিফজ করা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরআনুল কারিম হিফজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন, যদি কেউ নতুন ইসলাম গ্রহণ করত তাকে কুরআন শিক্ষার উপদেশ দিতেন এবং কোনো মুসলিমের নিকট সোপর্দ করতেন, যে তাকে কুরআন শিক্ষা দিবে। এ কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী গত হওয়ার পরও কুরআন অক্ষত, অবিকৃত ও সংরক্ষিত রয়েছে। উবাদাহ ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
্রكَانَ رَسُولُ اللَّهِ ــ صلي الله عليه وسلم ــ يُشْغَلُ، فَإِذَا قَدِمَ رَجُلٌ مُهَاجِرٌ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ــ صلي الله عليه وسلم ــ دَفَعَهُ إِلَى رَجُلٍ مِنَّا يُعَلِّمُهُ الْقُرْآنَগ্ধ.
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ব্যস্ত ছিলেন, যদি কোনো ব্যক্তি হিজরত করে তার নিকট আসত, তিনি আমাদের কারো নিকট তাকে সোপর্দ করতেন, যে তাকে কুরআন শিক্ষা দিবে”।
এ কারণে সাহাবিদের বৃহৎ সংখ্যা কুরআনুল কারিমের হাফিয ছিলেন, যেমন আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, তালহা, সাদ ও ইবনে মাসউদ প্রমুখগণ। কুরআনুল কারিম হিফয করা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও আদর্শ। তিনি হাফিয ছিলেন, রমদানের প্রতি রাতে জিবরীল ‘আলাইহিস সালামের সাথে তিনি কুরআনুল কারিম মুরাজা‘আহ করতেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
্রكَانَ رَسُولُ اللَّهِ ــ صلي الله عليه وسلم ــ يُعَلِّمُنَا التَّشَهُّدَ، كَمَا يُعَلِّمُنَا السُّورَةَ مِنَ الْقُرْآنِগ্ধ.
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন”। তাশাহহুদ শিক্ষার গুরুত্বকে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কুরআনুল কারিমের শিক্ষার সাথে তুলনা করেছেন, কারণ কুরআনুল কারিমের শিক্ষার গুরুত্ব সবার নিকট পরিচিত ছিল।
আমাদের আদর্শ পুরুষগণ সর্বপ্রথম কুরআনুল কারিম হিফযের প্রতি মনোনিবেশ করতেন, কারণ কুরআন হচ্ছে জ্ঞানের উৎস ও সকল জ্ঞানের মাপকাঠি। তারা অনেকে সাবালক হওয়ার পূর্বে তারা হিফয শেষ করেছেন।
মায়মুনি রহ. বলেন: “আমি একদা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাকে জিজ্ঞাসা করি, আমার ছেলেকে আগে কি শিক্ষা দিব কুরআন না-হাদিস, আপনি কি পছন্দ করেন? তিনি বললেন, তুমি আগে কুরআন শিক্ষা দাও। আমি বললাম, পূর্ণ কুরআন শিক্ষা দিব? তিনি বললেন: যদি তার পক্ষে পূর্ণ কুরআন হিফয করা কষ্টকর হয়, তাহলে অংশ বিশেষ শিক্ষা দাও”।
খতিব বাগদাদি রহ. বলেন: “তালিবে ইলম বা ইলম অন্বেষণকারীর কর্তব্য সর্বপ্রথম কুরআনুল কারিম হিফয করা, কারণ কুরআনুল কারিম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম ইলমের ভাণ্ডার”।
ইমাম আবু ওমর ইবনে আব্দুল বারর রহ. বলেন: “ইলম অর্জন করার কয়েকটি ধাপ, স্তর ও বিন্যাস রয়েছে, যা লঙ্ঘন করা শিক্ষার্থীর জন্য বাঞ্ছনীয় নয়… অতএব ইলম অর্জন করার প্রথম ধাপ হচ্ছে কুরআনুল কারিম হিফয করা ও তা বুঝা”।
ইমাম নববি রহ. বলেন: “সর্বপ্রথম কুরআনুল কারিম হিফয করা জরুরি। আদর্শ পুরুষগণ কুরআনুল কারিম হিফয করার পূর্বে কাউকে হাদিস ও ফিকহ শিক্ষা দিতেন না। কুরআন হিফয শেষে অন্যান্য ইলম তথা হাদিস-ফিকহে এতটুকুন মগ্ন হওয়া যাবে না, যার ফলে কুরআনুল কারিমের কোনো অংশ ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়”।
ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন: “মানুষ যেসব জ্ঞানকে ইলম বলে, তার সর্বাগ্রে হচ্ছে কুরআনুল কারিম হিফয করা”।
কুরআনুল কারিম হিফয করা খুব সহজ, তার সাথে মেধা অথবা বয়সের বড় সম্পর্ক নেই। অনেক মনীষী তাদের বার্ধক্য ও শেষ বয়সে কুরআনুল কারিম হিফয করেছেন, যারা আরবি জানে না তারাও হিফয করছেন। এ ক্ষেত্রে বড়দের চাইতে ছোটরা অনেক এগিয়ে।
কুরআনুল কারিম হিফয করা শরীয়তের নির্দেশ। হিফয করে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, মুসলিম যখন দৃঢ় ইচ্ছা ও প্রচণ্ড আগ্রহসহ হিফয আরম্ভ করে, অতঃপর অলসতা-শিথিলতা বা ব্যস্ততার কারণে হিফয ত্যাগ করে, তবুও কোনো ক্ষতি নেই, যা হিফয করেছে তা বৃথা যাবে না, কোনো অংশ হিফয না করলেও হিফযের হালাকায় তিলাওয়াতের সাওয়াব থেকে কখনো মাহরূম হবে না।
ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন: “যে কুরআনুল কারিম হিফয করল, সে তার বক্ষ ও পিঠের মাঝে নবুওয়তকে ধারণ করল”। অতএব মুসলিম হিসেবে সবাইকে এ গৌরব অর্জন করার নিমিত্তে ব্রত গ্রহণ করা জরুরি। আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন।

কুরানুল কারিম হাফেজি করার মর্যাদা ও ফজিলত

কুরআনুল কারিম হিফয করার ফজিলত
১. শয়তান থেকে ঘর নিরাপদ থাকে: সাধারণত হাফিয ও হিফয-শাখার ছাত্ররা সবচেয়ে বেশী কুরআন তিলাওয়াত করেন, তাই তাদের ঘর শয়তান থেকে নিরাপদ থাকে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রلاَ تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ، إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ البَيْتِ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ البَقرَةِগ্ধ. رواه مسلم
“তোমাদের ঘরগুলোকে তোমরা কবরে পরিণত করো না, নিশ্চয় সে ঘর থেকে শয়তান পলায়ন করে, যেখানে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয়।”
২. হাফিযগণ আল্লাহর পরিবার ভুক্ত: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রإِنَّ لِلَّهِ أَهْلِينَ مِنَ النَّاسِগ্ধ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ هُمْ؟ قَالَ: ্রهُمْ أَهْلُ الْقُرْآنِ أَهْلُ اللَّهِ وَخَاصَّتُهُগ্ধ.
“নিশ্চয় মানুষদের থেকে আল্লাহর কতক পরিবার (নিজস্ব লোক) রয়েছে, তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল তারা কারা? তিনি বললেন: তারা আহলে কুরআন, আল্লাহর পরিবার ও তার বিশেষ ব্যক্তিবর্গ”। কুরআনুল কারিমের হাফিয আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত, একজন মুসলিমের হিফয হওয়ার জন্য এ প্রেরণাই যথেষ্ট, এটা তাদের প্রতি আল্লাহর মহান অনুগ্রহ।
৩. হাফিযগণ সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রاغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَগ্ধ.
“পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটি বস্তুর পূর্বে গণিমত মনে কর: তোমার যৌবনকে তোমার বার্ধক্যের পূর্বে; তোমার সুস্থতাকে তোমার অসুস্থতার পূর্বে; তোমার সচ্ছলতাকে তোমার অভাবের পূর্বে; তোমার অবসরতাকে তোমার ব্যস্ততার পূর্বে এবং তোমার জীবনকে তোমার মৃত্যুর পূর্বে”। আহলে-কুরআন কখনো তিলাওয়াত করেন, কখনো হিফয করেন, কখনো গবেষণা করেন, কখনো তার উপর আমল করেন। এভাবে তারা প্রতি মুহূর্তের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারেন।
৪. হাফিযদের ঈমান উত্তরোত্তর বর্ধিত হয়: হাফিযগণ সর্বাধিক কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করেন, তাই তারা সবচেয়ে বেশী নবী-রাসূলদের বিজয়ের কাহিনী, কাফেরদের পরাজয়ের ঘটনা, মুমিনদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও কাফেরদের প্রতি তার গোস্বার বাণী পড়েন ও শ্রবণ করেন, যার ফলে তাদের ঈমান বর্ধিত হয়। জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
্রكُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ فِتْيَانٌ حَزَاوِرَةٌ، فَتَعَلَّمْنَا الْإِيمَانَ قَبْلَ أَنْ نَتَعَلَّمَ الْقُرْآنَ، ثُمَّ تَعَلَّمْنَا الْقُرْآنَ فَازْدَدْنَا بِهِ إِيمَانًاগ্ধ.
“আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, তখন সবেমাত্র কৈশোরে পদার্পণ করেছি। অতএব কুরআন শিখার আগে আমরা ঈমান শিখেছি, অতঃপর কুরআন শিখেছি, আর তার দ্বারা আমরা আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছি”।
৫. হাফিযগণ তাহাজ্জুদের স্বাদ অনুভব করে: হিফযের বদৌলতে হাফিযগণ তাহাজ্জুদের স্বাদ অনুভব করেন, হিফয না-থাকার কারণে অনেকে এ স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রمَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الْغَافِلِينَ، وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْقَانِتِينَ، وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْمُقَنْطِرِينَগ্ধ.
“যে ব্যক্তি দশ আয়াত নিয়ে কিয়াম করল, তাকে গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, আর যে এক-শো আয়াত নিয়ে কিয়াম করল, তাকে কানেতিন তথা ইবাদতকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, আর যে এক-হাজার আয়াত নিয়ে কিয়াম করল, তাকে মুকানতিরিণ তথা অনেক সওয়াব অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়”। কুরআনুল কারিম হিফয করা ব্যতীত এ সাওয়াব অর্জন করা সম্ভব নয়।
৬. হাফিযগণ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত: সালাত ইসলামের দ্বিতীয় রোকন, তাতে ইমামতের হকদার কুরআনুল কারিমের হাফিযগণ। আবু মাসউদ আনসারি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রيَؤُمُّ الْقَوْمَ، أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللَّهِ، فَإِنْ كَانُوا فِي الْقِرَاءَةِ سَوَاءً، فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ، فَإِنْ كَانُوا فِي السُّنَّةِ سَوَاءً، فَأَقْدَمُهُمْ هِجْرَةًগ্ধ.
“কওমের মধ্যে কুরআনের অধিক পাঠক (ধারক) তাদের ইমামত করবে; যদি তারা কিরাতে বরাবর হয়, তাহলে সুন্নত সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, যদি তারা সুন্নতে বরাবর হয়, তাহলে হিজরতে অগ্রগামী ব্যক্তি ইমামত করবে”।
শুধু জীবিত অবস্থায় নয়, মৃত অবস্থায় কবরেও তারা অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের শহীদদের দু’জনকে এক কাপড়ে কাফন দিচ্ছিলেন, অতঃপর বলতেন:
্রأَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ؟، فَإِذَا أُشِيرَ لَهُ إِلَى أَحَدِهِمَا قَدَّمَهُ فِي اللَّحْدِ، وَقَالَ: أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلَاءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَأَمَرَ بِدَفْنِهِمْ فِي دِمَائِهِمْ، وَلَمْ يُغَسَّلُوا، وَلَمْ يُصَلَّ عَلَيْهِمْগ্ধ.
“তাদের মাঝে কুরআনের অধিক ধারক কে”? যখন তাদের কাউকে চিহ্নিত করা হত, তিনি তাকে কবরে আগে রাখতেন; এবং বলতেন: “কিয়ামতের দিন আমি তাদের সাক্ষী হব”। তিনি তাদেরকে তাদের রক্তসহ দাফন করার নির্দেশ দেন, তাদের গোসল দেওয়া হয়নি এবং তাদের উপর সালাত আদায় করাও হয়নি”। অতএব কুরআনুল কারিমের হাফিয জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত।
৭. হাফিযগণ জান্নাতের উঁচু মর্যাদার অধিকারী: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রيُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ: اِقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدُّنْيَا، فَإِنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَاগ্ধ.
“কুরআনের ধারককে বলা হবে, ‘তুমি পড় ও চড় এবং তারতীলসহ পড়, যেভাবে তারতীলসহ দুনিয়াতে পড়তে। কারণ, তোমার মর্যাদা সর্বশেষ আয়াতের নিকট, যা তুমি পড়বে।” অপর হাদিসে এসেছে:
্রيَجِيءُ الْقُرْآنُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَلِّهِ فَيُلْبَسُ تَاجَ الْكَرَامَةِ، ثُمَّ يَقُولُ: يَا رَبِّ زِدْهُ فَيُلْبَسُ حُلَّةَ الْكَرَامَةِ، ثُمَّ يَقُولُ: يَا رَبِّ ارْضَ عَنْهُ فَيَرْضَى عَنْهُ، فَيُقَالُ لَهُ: اقْرَأْ وَارْقَ وَتُزَادُ بِكُلِّ آيَةٍ حَسَنَةًগ্ধ.
“কিয়ামতের দিন কুরআন আসবে ও বলবে: হে আমার রব, তাকে পরিধান করাও, তাকে সম্মানের টুপি পড়ানো হবে। অতঃপর সে বলবে: হে আমার রব, তাকে বৃদ্ধি করে দাও, তাকে সম্মানের অলঙ্কার পড়ানো হবে, অতঃপর সে বলবে: হে আমার রব তার উপর সন্তুষ্ট হও, তিনি তার উপর সন্তুষ্ট হবেন। অতঃপর তাকে বলা হবে: পড় ও উপড়ে চর এবং প্রত্যেক আয়াতের মোকাবিলায় একটি করে নেকি বর্ধিত করা হবে”।
৮. হাফিযগণ ঈর্ষার পাত্র: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রلَا حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ عَلَّمَهُ اللَّهُ الْقُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ، فَسَمِعَهُ جَارٌ لَهُ، فَقَالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ مَا أُوتِيَ فُلَانٌ فَعَمِلْتُ مِثْلَ مَا يَعْمَلُ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَهُوَ يُهْلِكُهُ فِي الْحَقِّ، فَقَالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ مَا أُوتِيَ فُلَانٌ فَعَمِلْتُ مِثْلَ مَا يَعْمَلُগ্ধ.
“দু’জন্য ব্যক্তি ব্যতীত কোনো হিংসা নেই, এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন, সে তা দিন-রাতের বিভিন্ন অংশে তিলাওয়াত করে। অতঃপর তার এক প্রতিবেশী শুনে বলে: যদি আমাকে অনুরূপ দেওয়া হত, যেরূপ অমুককে দেওয়া হয়েছে তাহলে আমিও তার মত আমল করতাম। আর অপর ব্যক্তি-যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, সে তা সত্য পথে খরচ করে। এক ব্যক্তি বলল: যদি অমুককে যেরূপ দেওয়া হয়েছে আমাকেও সেরূপ দেওয়া হয়, তাহলে আমিও করব যেরূপ সে করে”।
৯. হাফিযগণ দজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ: দজ্জালের আত্মপ্রকাশ কিয়ামতের সবচেয়ে বড় আলামত, দুনিয়াতে তার চেয়ে বড় কোনো ফিতনা নেই। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রمَنْ حَفِظَ عَشْرَ آيَاتٍ مِنْ أَوَّلِ سُورَةِ الْكَهْف عُصِمَ مِنَ الدَّجَّالِ গ্ধ.
“যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করবে তাকে দজ্জাল থেকে নিরাপদ রাখা হবে”।
১০. কুরআনুল কারিমের হিফয নেককার নারীদের দেন মোহর: অনেক আদর্শ পূর্বপুরুষ কুরআনুল কারিমের কতক মুখস্থ সূরার বিনিময় নেককার নারীদের বিয়ে করেছেন। সাহাল ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, জনৈক নারী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার নফস আপনাকে হেবা করতে এসেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন। অতঃপর তার দিকে তাকালেন ও অবনত করলেন, অতঃপর তিনি মাথা ঝুঁকালেন। মহিলাটি যখন দেখল, তিনি তার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না বসে পড়ল। তার সাহাবিদের থেকে একজন উঠে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, যদি আপনার তাকে প্রয়োজন না হয়, আমার নিকট তাকে বিয়ে দিয়ে দিন। তিনি বললেন: তোমার কিছু আছে? সে বলল: না, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন: বাড়িতে যাও, দেখ কিছু পাও কিনা? সে গেল, অতঃপর ফিরে আসল ও বলল: হে আল্লাহর রাসূল কিছু পায়নি। তিনি বললেন: দেখ, যদিও একটি লোহার আঙ্কটি পাও; সে বলল: তবে আমার এ লুঙ্গি আছে, তার জন্য তার অর্ধেক। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
্রمَا تَصْنَعُ بِإِزَارِكَ، إِنْ لَبِسْتَهُ لَمْ يَكُنْ عَلَيْهَا مِنْهُ شَيْءٌ، وَإِنْ لَبِسَتْهُ لَمْ يَكُنْ عَلَيْكَ شَيْءٌগ্ধ.
“সে তোমার লুঙ্গি দিয়ে কি করবে, যদি তুমি পরিধান কর তার উপর কোনো কাপড় থাকবে না, আর সে পরিধান করলে তোমার উপর কোনো কাপড় থাকবে না”? লোকটি বসে পড়ল, দীর্ঘক্ষণ বসে ছিল, অতঃপর দাঁড়ালো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন সে চলে যাচ্ছে, তাকে ডাকলেন, যখন সে আসল, তিনি বললেন:
্রمَاذَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ؟গ্ধ.
“তোমার সাথে কুরআনের কতটুকু অংশ আছে? সে বলল: আমার সাথে অমুক, অমুক ও অমুক সূরা রয়েছে, সে সবগুলো গণনা করল। তিনি বললেন:
্রأَتَقْرَؤُهُنَّ عَنْ ظَهْرِ قَلْبِكَ؟গ্ধ.
তুমি কি এগুলো মুখস্থ পড়তে পার? সে বলল: হ্যাঁ, তিনি বললেন:
্রاذْهَبْ فَقَدْ مَلَّكْتُكَهَا بِمَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِগ্ধ.
“যাও, তোমার সাথে কুরআনের যে অংশ আছে, তার বিনিময়ে আমি তোমাকে তার মালিক বানিয়ে দিলাম”।
এভাবে উক্ত সাহাবি কুরআনুল কারিম হিফযের বিনিময়ে বিয়ে করেছেন। হিফযের বিনিময়ে কেউ যদি আপনার নিকট মেয়ে বিয়ে না দেয় ধৈর্য দরুন, হিফযকে মোহর ধার্য করে জান্নাতে অনেক হুর বিয়ে করতে পারবেন।
কুরআনুল কারিম হিফয করার পদ্ধতি
আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অগাধ মহব্বত ও গভীর হৃদ্যতা থেকে কুরআনুল কারিম হিফয করার প্রতি উদ্যমী হোন। কুরআন হিফয করা সহজ ও তৃপ্তিদায়ক, যদি কতক পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়, তাহলে হিফয অতি সহজ, দ্রুত ও গতিশীল হয়। নিম্নে তাই কতিপয় পদ্ধতি উল্লেখ করছি:
১. হিফয করার শুরুতে নিয়ত বিশুদ্ধ করা: অশুদ্ধ নিয়তের কারণে কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম কুরআনুল কারিমের জনৈক কারীকে ডেকে চেহারার উপর ভর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রوَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟، قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِগ্ধ.
“আর ঐ ব্যক্তি যে ইলম শিক্ষা করেছে, অপরকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাকে জানিয়ে দেবেন তাঁর সকল নেয়ামত, ফলে সে তা জানবে। আল্লাহ বলবেন, ‘এ নেয়ামতসমূহের বিনিময়ে তুমি কি করেছ?’ সে বলবে, ‘আমি ইলম শিখেছি, অপরকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাঠ করেছি।’ তিনি বলবেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছ, তবে তুমি এ উদ্দেশ্যে ইলম শিখেছ, যেন লোকেরা তোমাকে আলেম বলে এবং এ উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছ, যেন লোকেরা তোমাকে কারী বলে। আর তা বলা হয়েছে।’ অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ জারি করা হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে অবশেষে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে”।
২. পার্থিব স্বার্থের জন্য কুরআনুল কারিম হিফয না করা: কুরআনের ভালো হাফিয ও সুললিত কারীদের মাঝে এ জাতীয় বিচ্যুতি বেশী পরিলক্ষিত হয়। অতএব তারা কুরআনুল কারিম দ্বারা পার্থিব সম্পদ, সম্মান, সাথীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব, মানুষের প্রশংসা কুড়ানো ও নিজের দিকে মানুষদের আকৃষ্ট করার ইচ্ছা পরিহার করুন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ ٢٠﴾ [الشورى: ٢٠]
“যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোনো অংশ থাকবে না”। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রمَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ، أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ، أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَগ্ধ.
“যে ইলম অন্বেষণ করল, যেন তার দ্বারা সে আলেমদের সাথে তর্ক করতে সক্ষম হয়, অথবা তার দ্বারা মূর্খদেরকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়, অথবা তার দ্বারা মানুষদের চেহারাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন”।
৩. দোয়া, ইস্তেগফার ও সকাল-সন্ধ্যার যিকরসমূহ পড়া: গুনাহ হিফযের প্রতিবন্ধক, তাই গুনাহ থেকে তওবা করা, হিফযের জন্য দোয়া করা ও সকাল-সন্ধ্যার যিকরসমূহ রীতিমত পাঠ করা কুরআনুল কারিম হিফযের জন্য সহায়ক। সকাল-সন্ধ্যার অযিফা দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছায় শয়তান থেকে সুরক্ষা মিলে ও সময় বরকতপূর্ণ হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করার সময় বলতেন:
্রأَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِগ্ধ.
এ দোয়া পাঠকারী সম্পর্কে শয়তান বলে, সারা দিন সে আমার থেকে নিরাপদ হয়ে গেল।
৪. একজন পরহেজগার মুয়াল্লিম নির্দিষ্ট করা ও রীতিমত হালাকায় উপস্থিত থাকা: কুরআনুল কারিম হিফয করার উদ্যোগ নেওয়ার পরবর্তী কাজ হচ্ছে একজন অভিজ্ঞ মুয়াল্লিম ঠিক করা। হিফয করার পূর্বে নির্ধারিত অংশ মুয়াল্লিমকে শুনিয়ে নিন, হিফয শেষে আবার শুনান, তাহলে আপনার হিফয নির্ভুল হবে। মুয়াল্লিম আলিম ও মুত্তাকী হলে কুরআনুল কারিমের হিফয ও তার আমল একসঙ্গে শিখা যায়। অর্থ, তাফসীর, তাকওয়া ও আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় জানা যায়, যা হিফযের জন্য সহায়ক। যদি নির্দিষ্ট কোনো হালাকার অধীন হিফয করার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে সেখানে রীতিমত উপস্থিত থাকা ও রুটিন মোতাবেক হিফয করা।
৫. প্রতিদিন নির্ধারিত সময় হিফয করা: হিফযের ব্রত গ্রহণকারী সর্বপ্রথম পুরো দিনের কাজ ও তার সময় বণ্টন করে নিন। অতঃপর হিফযের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করুন ও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করুন। হিফযের পরিমাণ কম বা বেশী যাই হোক প্রতিদিন নির্ধারিত সময় হিফয করুন। হিফযের জন্য তিনটি সময় বেশ উপযোগী: ক. ফজর সালাতের পূর্বাপর; খ. আসর সালাতের পর; ও ঘ. মাগরিব সালাতের পর।
ক. ফজর সালাতের পূর্বাপর: এশার পর দ্রুত ঘুমিয়ে ফজরের পূর্বে উঠে আল্লাহর তাওফিক মোতাবেক কয়েক রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ুন, অতঃপর জামাতের পূর্বাপর ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট হিফয করুন। ভোর বেলার হিফয দিনের কর্মস্থলে সময়-সুযোগ মত পাঠ করুন। এ সময় হিফযকারীকে অবশ্যই এশার পর রাতের প্রথম অংশ ঘুমাতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
্রأَنّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَ الْعِشَاءِ وَالْحَدِيثَ بَعْدَهَاগ্ধ.
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার পূর্বে ঘুমানো ও তারপর কথা বলা অপছন্দ করতেন”। পাবলিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত ও ব্যবসায়ীরা এ সময় হিফয করতে পারেন।
খ. আসর সালাতের পর: স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের জন্য এ সময়টা বেশ উপযোগী। আসর সালাত যারা প্রথম ওয়াক্তে পড়েন-তাদের জন্য এ সময়টা খুব দীর্ঘ; আর যারা পরবর্তী সময়ে পড়েন-তারা এতে কম সময় পান, অতএব তারা আসর সালাতের পূর্বে ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট হিফয করুন।
গ. মাগরিব সালাতের পর: হাফেযি মাদ্রাসা কিংবা বড় মাদ্রাসার অধীন হিফয শাখার ছাত্ররা এ সময় হিফয করে। শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ও সরকারী চাকুরীজীবীরা সাধারণত এ সময় অবসর থাকেন, তারা এতে হিফয করতে পারেন।
৬. কিভাবে হিফয করবেন: হিফয শুরু করার পূর্বে নির্ধারিত অংশের তিলাওয়াত ওয়াকফসহ শিখে নিন। ‌এক-লাইনকে দু’ভাগ করা বা দু’শ্বাসে পড়ার প্রয়োজন হলে, কিংবা বড় আয়াত ছোট-ছোট অংশে ভাগ করার প্রয়োজন হলে ওয়াকফ্ করার স্থান জেনে নিন, যেন অর্থ ঠিক থাকে ও পড়া শ্রুতিমধুর হয়। প্রথম আয়াত হিফয শেষে পরবর্তী আয়াত হিফয করুন এবং উভয় আয়াত একসাথে মিলিয়ে পড়ার পদ্ধতি জেনে নিন। এভাবে হিফয পরিপক্ব হয়। ধীরেধীরে হিফয করুন, সম্ভব হলে নির্ধারিত অংশের অর্থ জেনে নিন, তাহলে হিফয দ্রুত ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। নির্ধারিত সময়ে যতটুকু হিফয করা সম্ভব হয় তাই হিফয করুন ও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করুন। অতিরিক্ত চাপ ত্যাগ করুন এবং নতুন হিফযের তুলনায় পুরাতন হিফযের প্রতি অধিক মনোযোগ প্রদান করুন।
হিফয করা অংশ সুন্নত, নফল ও ফরয সালাতে তিলাওয়াত করুন। শেষ রাতের সালাতে তিলাওয়াত করা অধিক উত্তম, তখন আল্লাহ স্বীয় মর্যাদা মোতাবেক দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, আর বান্দাদের ডেকে বলেন:
্রمَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُগ্ধ.
“কে আমাকে আহ্বান করবে আমি তার ডাকে সারা দিব, কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে আমি তাকে প্রদান করব, কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে আমি তাকে ক্ষমা করব”।
হিফয করা অংশ কখনো দেখে কখনো মুখস্থ পড়ুন, সর্বদা দেখে পড়া হিফযের জন্য ক্ষতিকর, অনুরূপ সর্বদা মুখস্থ পড়া হিফয ও শুদ্ধতার জন্য বিপজ্জনক। কুরআনুল কারিমের প্রতি অধিক দৃষ্টি হিফযকে দৃঢ় করে, মনোযোগে গভীরতা আনে ও আয়াতের সাথে আন্দোলিত হতে সাহায্য করে, তাই চিন্তা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে দেখে-দেখে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন। আবার হিফযকে যাচাই ও নজরদারী করার জন্য মুখস্থ পড়ুন।
৭. নেককার প্রতিযোগী গ্রহণ করা: কুরআনুল কারিম হিফয করার জন্য নেককার প্রতিযোগী গ্রহণ করুন। হিফযের ক্ষেত্রে সহপাঠী কেউ থাকলে দু’জনের মাঝে সুন্দর প্রতিযোগিতা গড়ে উঠে, হিফযের সাহস ও স্পৃহা বৃদ্ধি পায় এবং সর্বদা মনে পড়ে যে, এ কল্যাণের ক্ষেত্রে আমার সাথী আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
৮. পিছনের পড়ার প্রতি যতœ নিন:
কুরআনুল কারিম খুব দ্রুত হিফয হয়, কিন্তু রীতিমত তিলাওয়াত না করলে দ্রুত ভুলিয়ে দেওয়া হয়। ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রإنَّمَا مَثَلُ صَاحِبِ الْقُرْآنِ كَمَثَلِ الإِبِلِ المُعَقَّلَةِ، إِنْ عَاهَدَ عَلَيْهَا أَمْسَكَهَا، وَإِنْ أَطْلَقَهَا ذَهَبَتْগ্ধ. متفقٌ عَلَيْهِগ্ধ.
“নিশ্চয় কুরআনের ধারকের উদাহরণ বাঁধা উটের উদাহরণের ন্যায়, যদি সে তাকে বেঁধে রাখে আটকে রাখবে, আর তাকে ছেড়ে দিলে সে চলে যাবে।” মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, মুসা ইবনে উকবাহ অত্র হাদিস শেষে অতিরিক্ত বর্ণনা করেন:
্রوَإِذَا قَامَ صَاحِبُ الْقُرْآنِ فَقَرَأَهُ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ ذَكَرَهُ، وَإِذَا لَمْ يَقُمْ بِهِ نَسِيَهُগ্ধ.
“কুরআনুল কারিমের ধারক যদি (কুরআন নিয়ে) কিয়াম করে, অতঃপর দিন-রাত তা তিলাওয়াত করে, তাহলে কুরআন স্মরণ রাখবে, আর যদি কুরআন নিয়ে কিয়াম না করে তা ভুলে যাবে”।
পিছনের হিফয দৃঢ় করে সামনে মুখস্থ করুন। প্রতিদিন হিফযের জন্য যে সময় নির্ধারিত থাকবে, অল্প হলেও তাতে পিছনের পড়ার রুটিন রাখুন। হিফযের পরিমাণ বেশী হলে কখনো নতুন হিফয বন্ধ করে পিছনের হিফয মজবুত করুন। এতে ঢিলেমি না করা, কারণ পিছনের পড়া মুখস্থ না থাকলে হিফযের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। আবার এ ইচ্ছাও না করা যে, সবক শেষ করে পরবর্তীতে হিফয মজবুত করব, এ জাতীয় ইচ্ছা সাধারণত পূরণ হয় না।
৯. কুরআনুল কারিম শিক্ষার্থীর কতিপয় গুণগান: পোশাক, শরীর ও মুখমণ্ডল পরিষ্কার রাখা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, মুয়াল্লিম ও সহপাঠীদের সাথে বিনয়ী ও সহনশীল হওয়া, তাদের সাথে আদব রক্ষা করা। মুয়াল্লিমের সামনে উঁচু সরে কথা না বলা, যদিও তার বয়স কম হয়। অধিক হাসাহাসি ও খেলা-ধুলা ত্যাগ করা, তবে হাসি-খুশি থাকা, যেন তার প্রতি মুয়াল্লিমের মহব্বত সৃষ্টি হয়।
মুয়াল্লিম থেকে কখনো কঠোর আচরণ প্রকাশ পেলে তাকে পরিহার না করা, আদব রক্ষা করা ও পড়া-শুনার প্রতি আগ্রহী থাকা। কুরআন পবিত্র বীজের ন্যায়, যা উর্বর ও পরিচ্ছন্ন জমি ব্যতীত গজায় না, তাই কুরআনুল কারিম হিফযের জন্য হিংসা ও কপটতা মুক্ত পবিত্র অন্তর থাকা চাই। হিংসা করার অর্থ আল্লাহর তকদীরে আপত্তি করা। আবার কারো হিংসার পাত্র হতে নেই, কারণ চোখেরও হক আছে। অতএব বদ-নজর থেকে সুরক্ষা ও ইখলাস ধরে রাখার স্বার্থে আপনার হিফয গোপন রাখুন। সৎ ও মহৎ চরিত্রগুণে গুণান্বিত হোন, অহংকার ও অহমিকা থেকে মুক্ত থাকুন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রوَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللَّهُগ্ধ.
“আল্লাহর জন্য কেউ বিনয়ী হয়নি তবে অবশ্যই আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন”।
১০. নির্দিষ্ট ছাপার কুরআন পড়া: হিফযের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই নির্দিষ্ট ছাপার কুরআন তথা হাফেযি কুরআন পড়া জরুরি। কারণ স্মৃতি শক্তির ন্যায় চোখও হিফয করে, তাই হাফেযি কুরআন পড়লে সূরা ও আয়াতের অবস্থান মনে থাকে, প্রয়োজনের সময় নির্দিষ্ট স্থান থেকে নির্দিষ্ট আয়াত খোঁজে নেওয়া সহজ হয়।