বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

কুরানুল কারিম শিক্ষাদান কারীর কী কী গুণ থাকা দরকার

কুরআনুল কারিম শিক্ষাদানকারীর আদব
আল্লাহ তা‘আলা যেরূপ কুরআন নাযিল করেছেন, অনুরূপ তা শিক্ষা দেওয়ার কতিপয় আদব নাযিল করেছেন, যা প্রত্যেক মুয়াল্লিমের জানা জরুরি। কারণ, আদব হচ্ছে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যকার বন্ধন ও যোগসূত্র। আদব যেরূপ গভীর ও অকপট হয়, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সেরূপ দৃঢ় ও মজবুত হয়। আদব সুন্দর হলে শিক্ষার আদান-প্রদান সুন্দর, ব্যাপক ও বরকতময় হয়। তাই নিম্নে মুয়াল্লিমের কতিপয় আদব উল্লেখ করছি:
১. কুরআনুল কারিমকে আদর্শ বানানো: কুরআনুল কারিমের শিক্ষক সর্বপ্রথম নিজেকে কুরআনুল কারিমের আখলাক দ্বারা সজ্জিত করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ ١٢١ ﴾ [البقرة: ١٢١]
“আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে”।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, তারা যথাযথভাবে কুরআনুল কারিম অনুসরণ করে”। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়ে ছিল, তিনি বলেন:
্রكَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَগ্ধ.
“তার আখলাক ছিল কুরআন”। অতএব নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ন্যায় কুরআনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা তার উত্তরসূরির প্রথম কাজ।
২. উপযুক্ত জায়গায় তালিম দেওয়া: কুরআনুল কারিম শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করা জরুরি। শিক্ষার্থীর সাথে সম্পৃক্ত বা তার মালিকানাধীন জায়গায় তালিম না দেওয়া, শাসক কিংবা ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে পাঠদান থেকে বিরত থাকা শ্রেয়। আমাদের আদর্শ পূর্বপুরুষগণ শিক্ষার্থীর সাথে সম্পৃক্ত জায়গায় বসে দীনি শিক্ষা প্রদান করেননি। এটা অহংকার নয়, বরং ইলমের মর্যাদার সুরক্ষা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রلَا يَنْبَغِي لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يُذِلَّ نَفْسَهُগ্ধ.
“নিজেকে অসম্মান করা কোনো মুমিনের পক্ষে সমীচীন নয়”। অপর হাদিসে তিনি বলেন:
্রخَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ গ্ধ.
“তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি যে-কুরআন শিখে ও তা শিখায়”।
৩. শিক্ষার্থীর প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ প্রদান করা: শিক্ষার্থীর প্রতি মুয়াল্লিমের পূর্ণ মনোনিবেশ করা, তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার খবরাখবর নেওয়া শিক্ষকের বিশেষ গুণ। পাঠদানের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কথা বা কাজে মগ্ন না হওয়া, পরিপূর্ণ মনোযোগসহ সবার তিলাওয়াত শ্রবণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤﴾ [الاعراف: ٢٠٣]
“যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তোমরা মনোযোগসহ শ্রবণ কর ও তার জন্য চুপ থাক, তাহলে তোমাদের উপর রহম করা হবে”।
৪. শিক্ষার্থীদের মাঝে ইনসাফ ও সমতা বজায় রাখা: ছোট-বড়, ধনী-গরীব সবার ক্ষেত্রে ইনসাফ বজায় রাখা, প্রত্যেককে তাদের অধিকার পাইয়ে দেওয়া। কুরআন শিক্ষাদানকারীর পক্ষে সমীচীন নয় ধনীকে কাছে নেওয়া, গরীবকে দূরে ঠেলে দেওয়া, ধনীর জন্য বিনয়ী হওয়া ও গরীবের জন্য কঠোর হওয়া। উপযুক্ত কারণ ব্যতীত কাউকে কারো উপর প্রাধান্য না দেওয়া। কাউকে সম্বোধন করে কাউকে পরিত্যাগ না করা, সবার প্রতি সমান দৃষ্টি ও সমান মনোযোগ প্রদান করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ بِٱلۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلَّهِ ١٣٥ ﴾ [النساء : ١٣٥]
“হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে”।
৫. ধৈর্যধারণ করা: কারো থেকে ভুল বা অসংলগ্নতা প্রকাশ পেলে ধৈর্যধারণ করা, তিরস্কার ও অসম্মান না করা। শিক্ষার্থীদের ঘনিষ্ঠ হওয়া, তারা যেন মুয়াল্লিমকে পেয়ে খুশি হয়। বেশী রূঢ় বা বেশী শিথিল না হওয়া, বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রإِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِগ্ধ. وفي رواية لمسلم: ্রإِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُগ্ধ.
“নিশ্চয় আল্লাহ সহনশীল, সহনশীলতা পছন্দ করেন এবং তিনি সহনশীলতার বিনিময়ে যা প্রদান করেন, তা কখনো কঠোরতার বিনিময়ে প্রদান করেন না”। মুসলিমের এক বর্ণনা রয়েছে: “কোনো বস্তুতে নম্রতা অবস্থান করে না, তবে অবশ্যই নম্রতা ঐ বস্তুকে সুন্দর করে এবং কোনো বস্তু হতে নম্রতা অপসারণ করা হয় না, তবে অবশ্যই নম্রতার অনুপস্থিতি ঐ বস্তুকে বিনষ্ট করে”। আইয়ুব সাখতিয়ানী রহ. বলেন: “আলেমের উচিত আল্লাহর প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিজের মাথার উপর মাটি রাখা”।
৬. শিক্ষার্থীদের কল্যাণ কামনা করা: কুরআন পড়তে আসা শিক্ষার্থীকে স্বাগত জানানো ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করা বিশেষ এক আদব। আবু হারুন আবাদি রহ. বলেন, আমরা আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট আসতাম, তিনি বলতেন, তোমাদেরকে স্বাগতম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের জন্য কল্যাণ কামনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
্রإِنَّ النَّاسَ لَكُمْ تَبَعٌ وَإِنَّ رِجَالًا يَأْتُونَكُمْ مِنْ أَقْطَارِ الْأَرَضِينَ يَتَفَقَّهُونَ فِي الدِّينِ فَإِذَا أَتَوْكُمْ فَاسْتَوْصُوا بِهِمْ خَيْرًاগ্ধ.
“নিশ্চয় মানুষেরা তোমাদের অনুসারী, আর নিশ্চয় দীন শিখার জন্য মানুষেরা দুনিয়ার দিগন্ত থেকে তোমাদের নিকট আসবে, যখন তারা তোমাদের নিকট আসবে তোমরা তাদের কল্যাণ কামনা কর”। অপর হাদিসে তিনি বলেন:
্রالدِّينُ النَّصِيحَةُ، قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ: لِلَّهِ، وَلِكِتَابِهِ، وَلِرَسُولِهِ، وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ، وَعَامَّتِهِمْগ্ধ.
“নিশ্চয় দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা, আমরা বললাম: কার জন্য? তিনি বললেন: আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রাসূলের জন্য ও মুসলিমদের ইমামদের জন্য ও তাদের সর্বসাধারণের জন্য”। অতএব কুরআনুল কারিমের শিক্ষার্থীদের সাথে কল্যাণ কামনা করা কুরআনুল কারিমের সাথে কল্যাণ কামনা করার অংশ।
আহলে-ইলমগণ বলেন, কোনো শিক্ষার্থীর নিয়ত অশুদ্ধ প্রমাণিত হলে তাকে ইলমে-দীন শিখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা তার প্রতি অনুগ্রহ করার শামিল। সুফইয়ান রহ. বলেন: “ইলম শিক্ষার পিছনে সবার নিয়ত থাকে, আমরা গায়রুল্লার জন্য ইলম শিখে ছিলাম, কিন্তু ইলম গায়রুল্লাহর জন্য হতে অস্বীকার করেছে”।
৭. শিক্ষার্থীদের উপদেশ দেওয়া: শিক্ষার্থীদের কুরআনুল কারিমের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা, সময়-সুযোগ বুঝে হাফিযদের মর্যাদার কথা আলোচনা করা, হিফয করার উপকারিতা, তিলাওয়াত করার আদব আলোচনা করা এবং দুনিয়া সংগ্রহ ও তাতে মগ্ন হওয়া থেকে সতর্ক করা আদর্শ শিক্ষকের এক বিশেষ গুণ।
৮. আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করা: কুরআনুল কারিমের মুয়াল্লিমের পক্ষে সমীচীন নয় স্বীয় প্রয়োজন মানুষের নিকট পেশ করা। তিনি সকল প্রয়োজন আল্লাহর নিকট পেশ করবেন এবং সম্পদশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকবেন। চেষ্টা করবেন যেন মানুষের প্রয়োজন তার মাঝে সৃষ্টি হয়, মানুষ যেন দীনের জন্য তার মুখাপেক্ষী হয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্রمَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ تعالى لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِগ্ধ.
“যে এমন ইলম শিখল, যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়, অথচ সে তা শিখেছে একমাত্র দুনিয়ার সম্পদ অর্জন করার জন্য, কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না”।
অতএব কুরআনুল কারিমের মুয়াল্লিমগণ স্বীয় প্রতিদান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, যেমন নবী-রাসূলগণ করতেন। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَآ أَسۡ‍َٔلُكُمۡ عَلَيۡهِ مِنۡ أَجۡرٍۖ إِنۡ أَجۡرِيَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٠٩ ﴾ [الشعراء : ١٠٩]
“আর আমি তার (দীন শিখানোর) উপর তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না, আমার পারিশ্রমিক শুধু সৃষ্টিকুলের রবের নিকট”।
৯. কুরআনুল কারিমের মুয়াল্লিমের আরো কতিপয় গুণ: দানশীল ও উদার হওয়া, আল্লাহ তাকে প্রদান করলে মানুষকে প্রদান করা, তার উপর সংকীর্ণ করা হলে বিরত থাকা। দুনিয়ার মোহ ও তার সামগ্রীর সাথে সম্পৃক্ত না হওয়া। পিতা-মাতার খিদমত করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা। সাথীদের কল্যাণ কামনা করা, দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও গাম্ভীর্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া, অধিক হাসি-ঠাট্টা থেকে বিরত থাকা।
কথা বলার প্রয়োজন হলে বলা, অন্যথায় চুপ থাকা। অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করা। জিহ্বার অনিষ্ট থেকে নাজাতের জন্য শত্রুর মত তাকে ভয় করা, শত্রুকে বন্ধী রাখার মত তাকে বন্ধী রাখা।
নিজের প্রশংসা না করা, নফস থেকে সতর্ক থাকা, গীবত পরিহার করা, কাউকে খাটো না করা, কারো মুসিবত দেখে খুশি না হওয়া, কারো উপর সীমালঙ্ঘন না করা, কারো সাথে হিংসা না করা, প্রমাণ ব্যতীত কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করা। নিষিদ্ধ বস্তু হতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিফাজত করা। মুখ ও হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়া, কারো উপর জুলম না করা, জুলমের শিকার হলে সম্মানজনকভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, অন্যথায় ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহকে সন্তুষ্ট ও শত্রুকে রাগান্বিত করার জন্য গোস্বাকে হজম করা। সত্য যার পক্ষ থেকে প্রকাশ হোক গ্রহণ করতে বিলম্ব না করা।
অর্থ উপার্জন করার নিম্নমানের পেশা ও পদ্ধতি পরিহার করা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা, শরীর দূর গন্ধ মুক্ত রাখা, দাঁড়ি ছেড়ে দেওয়া ও মোচ ছোট করা।
১০. শিক্ষার্থীদের মহব্বত করা: শিক্ষার্থীদের মহব্বত করা ও তাদের রুচি-সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখা, স্বীয় নফস ও নিজ সন্তানের ন্যায় তাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করা, নিজ সন্তানের দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণ সহ্য করার ন্যায় তাদের অসদাচরণ সহ্য করা আদর্শ শিক্ষকের বিশেষ গুণ। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
্রأكرم الناس علي جليسي الذي يتخطى الناس حتى يجلس إلي لو استطعت أن لا يقع الذباب على وجهه لفعلت ، وفي رواية إن الذباب ليقع عليه فيؤذينيগ্ধ.
“আমার নিকট আমার সে ছাত্র বেশী প্রিয়, যে মানুষদের ডিঙ্গিয়ে আমার নিকট বসে, যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত তার চেহারায় কোনো মাছি বসবে না, আমি তাই করতাম”। অপর বর্ণনায় রয়েছে: “তার উপর মাছি বসে, তাও আমাকে কষ্ট দেয়”।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন