বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

হাফেজি ক্লাসের পরিচিতি

হিফয বিভাগ  বা শ্রেণির  পরিচিতি
হিফয বিভাগের ছাত্র/ ছাত্রীর অর্থ সবার হিফয পড়া জরুরি নয়, বরং হিফযের উদ্দেশ্যে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে হিফয শাখার ছাত্র-ছাত্রী বলা হয়। সাধারণত প্রত্যেক হিফয শাখায় তিন প্রকার ছাত্র/ ছাত্রী থাকে: ক. হিফয গ্রুপ, খ. নাজেরা গ্রুপ, গ. নুরানী বা কায়েদা গ্রুপ। নিম্নে প্রত্যেক গ্রুপের পরিচয় পেশ করছি:
নুরানী বা কায়েদা গ্রুপ: নুরানী বা কায়েদা গ্রুপের ছাত্র/ ছাত্রীরা আরবি হরফ, হরকত, শব্দ ও বাক্য পড়তে শিখে। মুয়াল্লিম ‘কায়েদা গ্রুপে’র জন্য সর্বপ্রথম একটি ভালো কায়েদা বেছে নিন। অতঃপর কায়েদা থেকে তাদেরকে আরবি হরফের পরিচয় ও তার বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা দিন। প্রতিটি হরফের স্থানভেদে বিভিন্ন আকৃতি ও গঠনের পরিচয় প্রদান করুন। কালিমার শুরুতে, মধ্যবর্তী ও শেষ অবস্থার ভিত্তিতে কোনো হরফের দু’টি, কোনো হরফের চারটি আকৃতি হয়, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তা আত্মস্থ করতে সাহায্য করুন। আরবি হরফ জানা শেষে প্রথম হরকত, অতঃপর ধীরেধীরে কায়েদার ধারাক্রম মোতাবেক শব্দ ও বাক্য শিক্ষা দিন।
তাজবিদের নিয়ম-কানুন শিখানোর চাইতে তাজবিদের সঠিক প্রয়োগ শিক্ষা দিন। ছাত্র/ ছাত্রী যদি ছোট ও প্রাথমিক অবস্থার হয়, তাদেরকে তাজবিদের নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে বুঝানো ঠিক নয়, আপনি বিশুদ্ধ উচ্চারণ করে তালিম দিন, আপনার উচ্চারণ থেকে তারা মাদ-গুন্না, ইযহার, ইদগাম ও ইকলাবের সঠিক প্রয়োগ শিখবে। উদাহরণের মাধ্যমে শিক্ষা দিন, যেমন কোনো শব্দে নুন সাকিন বা তানবীনের পর ‘বা’ হরফ থাকায় তাকে ইকলাবের উচ্চারণ শিখিয়েছেন। এ উদাহরণটি মুয়াল্লিম হিসেবে আপনি মনে রাখুন এবং শিক্ষার্থীকে এরূপ দু’চারটি উদাহরণ খুঁজে বের করতে বলুন। তাকে বলে দিন এরূপ হলে এভাবে উচ্চারণ করতে হয়। দ্বিতীয়বার যখন এ শব্দটি আসবে তাকে সঠিক উচ্চারণ করতে বলুন, ভুল হলে কায়দায় বিদ্যমান প্রথম শব্দটি খুঁজে দিন এবং সেখান থেকে উচ্চারণ শুদ্ধ করুন।
এভাবে ছোট-বাচ্চাদের নিয়ে সামনে অগ্রসর হলে তাজবিদের নিয়ম-কানুন মুখস্থ করার বাড়তি চাপ অনুভব করার পূর্বে তারা তাজবিদ শিখবে সন্দেহ নেই। কতক কায়দায় তাজবিদের নিয়মানুসারে হরফগুলো বিভিন্ন রং করা থাকে, বাচ্চাদের জন্য তা অধিক সহজ। আপনার প্রচেষ্টা ও শিক্ষার্থীর ধারাবাহিকতা পরস্পর সঙ্গী হলে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে কায়েদা শেষ হবে, ইনশাআল্লাহ।
বিশুদ্ধ কায়েদা: আমাদের দেশীয় ‘নুরানী কায়েদা’-তে আরবি হরফের সঠিক সংখ্যা ও বিন্যাস যথাযথ নয়। আরবি হরফ ২৮-টি এবং বিন্যাস নিম্নরূপ:
خ ح ج ث ت ب أ
ص ش س ز ر ذ د
ق ف غ ع ظ ط ض
ي و ه ن م ل ك
উর্দু-ফারসির সংমিশ্রণের ফলে আমাদের দেশে আরবি হরফগুলো তার স্বতন্ত্র হারিয়েছে। সৌদি আরব থেকে প্রিণ্টকৃত নুর মুহাম্মদ হক্কানী সাহেবের নুরানী কায়দাতেও আরবি হরফের সংখ্যা ও বিন্যাস ঠিক নেই, সেখানে আরবি হরফ ৩০টি রয়েছে, অন্যান্য কায়দায় সাধারণত ২৯-টি বিদ্যমান । বস্তুত আরবি হরফ ২৮টি।
জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে হামযাহ ও আলিফ থেকে। এ দু’টি হরফকে মূল হরফ গণনা করায় হরফ সংখ্যা ২৯টি হয়েছে, অথচ আলিফ মূল হরফ নয়। আলিফ হচ্ছে দীর্ঘ স্বর, যা ফাতহার (জবর) সাথে উচ্চারণ হয়। ফাতহার পর আলিফ হলে ফাতহার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়, আলিফ না হলে ফাতহার উচ্চারণ হ্রস্ব স্বর হয়। অথবা বলুন, আলিফ হচ্ছে মাদের (দীর্ঘ স্বরের) হরফ। আরবিতে মাদের হরফ তিনটি: ‘আলিফ’, ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’। ‘দাম্মা’র পর মাদের হরফ ‘ওয়া’ হলে দাম্মার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়; কাসরার পর মাদের হরফ ‘ইয়া’ হলে কাসরার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়; ফাতহার পর মাদের হরফ আলিফ হলে ফাতহার উচ্চারণ দীর্ঘ স্বর হয়। দাম্মা, কাসরা ও ফাতহার পর মাদের হরফ ‘আলিফ’, ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’ না হলে তাদের উচ্চারণ হ্রস্ব স্বর হয়।
উল্লেখ্য, ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’ মূল বা স্বতন্ত্র হরফ হিসেবেও ব্যবহার হয়। অতএব ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’র দু’টি মান: মূল হরফের মান ও হরফে ইল্লতের মান। তাই ‘ওয়া’ ও ‘ইয়া’তে যদি দাম্মাহ, ফাতহা ও কাসরা হয় এবং তার পরে যদি মাদের হরফ না হয়, তাহলে তার উচ্চারণ হবে অন্যান্য হরফের ন্যায় হ্রস্ব স্বর। যদি তার পরে মাদের হরফ হিসেবে ‘ওয়া’, ‘ইয়া’ কিংবা আলিফ হয়, তাহলে তার উচ্চারণ হবে দীর্ঘ স্বর। আলিফ শুধু মদের হরফ হিসেবে উচ্চারণ হয়। তাই তার উপর হরকত শুদ্ধ নয়, কিংবা আলিফের উপর হরকত হলে তা আলিফ থাকে না, হামযাহ হয়ে যায়।
আরবি পরিভাষা ব্যবহার করুন: জের, জবর ও পেশ ফারসি পরিভাষার পরবর্তীতে আরবি পরিভাষা দাম্মাহ, ফাতহা, কাসরা, সুকুন ও শাদ্দাহ ব্যবহার করুন। বানান পদ্ধতি প্রয়োজনে কারো থেকে শিখে নিন, তবুও বাচ্চাদেরকে আরবি পরিভাষা দ্বারা কুরআনুল কারিম শিক্ষা দিন।
নাজেরা গ্রুপ: কায়েদা শেষ করে ছাত্র/ ছাত্রীরা নাজেরা গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। দেখে-দেখে কুরআনুল কারিম দ্রুত ও শুদ্ধভাবে পড়তে শিখাকে নাজেরা বলা হয়। নাজেরা পড়ুয়া ছাত্র/ ছাত্রীদের প্রতি মুয়াল্লিম অধিক যতœ নিন, যেন যথাযথভাবে তারা তাজবিদের ব্যবহার ও তার সঠিক প্রয়োগ শিখে। শুরুতে তাদের কয়েকটি সূরা মুখস্থ করিয়ে নিন; যেমন সূরা ফাতিহা, নাস, ফালাক ও ইখলাস থেকে সূরা ফীল বা তাকাসুর পর্যন্ত সূরাসমূহ। অতঃপর ত্রিশতম পারা নাজেরা পড়ান। ত্রিশতম পারার নাজেরা শেষে মুয়াল্লিম সিদ্ধান্ত নিবেন ছাত্র/ ছাত্রী হিফয পড়বে-না আরো কয়েক পারা নাজেরা পড়বে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে তাদের ইচ্ছা ও রুচি জেনে নিন। যদি ছাত্র/ ছাত্রীর চাওয়া ও মুয়াল্লিমের অভিজ্ঞতা এক হয় খুব ভালো, অন্যথায় মুয়াল্লিমের অভিজ্ঞতার দাবি তাদেরকে বুঝিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বলুন।
হিফয পড়ার উপযুক্ত কোনো ছাত্র/ ছাত্রী নাজেরাহ পড়তে চাইলে বলুন, নাজেরাহ পড়ার অর্থ সময় নষ্ট করা ও পিছিয়ে পড়া; কয়েক পড়া হিফয করলে তোমার তিলাওয়াতের ধীরগতি দূর হয়ে যাবে এবং যে কোনো স্থান থেকে তুমি বিনা জড়তায় পড়তে পারবে। অনুরূপ নাজেরা পড়ার উপযুক্ত কোনো ছাত্র/ ছাত্রী হিফয পড়তে চাইলে বলুন, নাজেরা দ্রুত না হলে হিফয গতিশীল হয় না। অতএব তোমার জন্য নাজেরা উত্তম।
নাজেরা পড়ার উপযুক্ত কোনো ছাত্র/ ছাত্রী হিফয পড়তে আগ্রহী হলে তাকে হিফয পড়ার সুযোগ দিন, তার হিম্মতকে ধন্যবাদ জানান ও তাকে সাহায্য করুন যেন প্রতি পৃষ্ঠা হিফয করার পূর্বে নাজেরা বিশুদ্ধ ও তিলাওয়াত গতিশীল করে নেয়।
এভাবে ছাত্র-শিক্ষকের গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অবশ্যই অভিভাবককে অবহিত করুন, সন্তান বা প্রিয় পোষ্যের ইতিবাচক দিকগুলো অভিভাবকের সামনে তুলে ধরুন। অভিভাবক হাফেয বা গায়রে-হাফেয, পড়ুয়া বা আনপড় যে কেউ হোক তাকে কোনো তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করা ঠিক নয়।
আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত, ছয়/ সাত বছরের একজন ছাত্র/ ছাত্রী চার থেকে পাঁচ বা ছয় মাস কায়েদা ও অবশিষ্ট ছয় মাস নাজেরা পড়ার পর দ্বিতীয় বছর হিফযের উপযোগী হয়, তবে মেধা ও মনোযোগিতার তারতম্যের কারণে কম-বেশী হওয়া স্বাভাবিক।
হিফয গ্রুপ: হিফয বিভাগের শিক্ষার্থীরা নাজেরা সমাপ্ত করে হিফয গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী কায়েদাহ সমাপ্ত করে নাজেরা গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। অতঃপর ছয় মাস নাজেরা পড়ার পর হিফয গ্রুপে উত্তীর্ণ হয়। সাধারণত কায়েদা ও নাজেরা গ্রুপে এক বছরের বেশী সময়ের প্রয়োজন হয় না। একজন শিক্ষার্থী যখন হিফযের উপযোগী হয়, তখন সে তাজবিদসহ কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার যোগ্যতা অর্জন করে। অর্থাৎ সে আরবি হরফের বিশুদ্ধ উচ্চারণ, মাদ ও গুন্নাসহ বিনা জড়তায় কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করতে সক্ষম হয়। কোথাও সামান্য জড়তা থাকলে ১/২ পড়ার ফলে তা দূর হয়ে যায়।
হিফয গ্রুপে উত্তীর্ণ ছাত্র/ছাত্রীরা নাজেরা গ্রুপে থাকাবস্থায় সূরা ফীল থেকে সূরা নাস, কিংবা তার চেয়ে অধিক সংখ্যক সূরা মুখস্থ করেছে। অতএব এখন সে হুমাযাহ বা তার পরবর্তী মুখস্থ সূরার পর থেকে হিফয আরম্ভ করবে। প্রথম ত্রিশ, ঊনত্রিশ ও আটাশতম পারাসমূহ মুখস্থ করা ভালো, ইচ্ছা হলে ৫ থেকে ১০ পারাও মুখস্থ করা যায়। আবার সূরা বাকারা থেকে মুখস্থ শুরু করা কোনো সমস্যা নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন