বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

হিফজ বিভাগের শিক্ষাথীদের শাস্তি বা এর সীমারেখা

শাস্তি প্রদান করার বিধান
ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকদের নিকট আমানত। তারা শিক্ষার্থীদের ভদ্র আচরণ, ইলম ও আখলাক শেখাবেন, একান্ত প্রয়োজন হলে উত্তম-মাধ্যম করবেন। এটাই হানাফি , মালিকি , শাফেয়ী ও হাম্বলি ফকিহদের অভিমত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِগ্ধ.
“তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, সবাইকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে”। অপর হাদিসে তিনি বলেন,
্রلَا يَسْتَرْعِي اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَبْدًا رَعِيَّةً، قَلَّتْ أَوْ كَثُرَتْ، إِلَّا سَأَلَهُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، أَقَامَ فِيهِمْ أَمْرَ اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَمْ أَضَاعَهُ؟ حَتَّى يَسْأَلَهُ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ خَاصَّةًগ্ধ.
“আল্লাহ কোনো বান্দাকে যখন কোনো দায়িত্ব প্রদান করেন, কম হোক বা বেশী হোক, তিনি অবশ্যই তাকে কিয়ামতের দিন সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, সে কি তাদের (অধীনদের) মাঝে আল্লাহর বিধান কায়েম করেছে, না বিনষ্ট করেছে? অবশেষে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে বিশেষভাবে”।
এ হাদিস বলে শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই দায়িত্বশীল। শিক্ষার্থী বা পরিবারের কোনো সদস্য অবাধ্য হলে প্রথমত মারধর ব্যতীত শোধরানোর অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করুন। তাদের সাথে নম্র আচরণ করুন, পর্যায়ক্রমে সহজ থেকে কঠোর হোন। ওমর ইবনে আবু সালামাহ বলেন,
্রكُنْتُ غُلَامًا فِي حَجْرِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَتْ يَدِي تَطِيشُ فِي الصَّحْفَةِ، فَقَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: يَا غُلَامُ، سَمِّ اللَّهَ وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَগ্ধ.
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে ছোট বাচ্চা ছিলাম, আমার হাত প্লেটের চতুর্দিক যেত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে গোলাম, আল্লাহর নাম বল, তোমার ডান হাতে খাও ও তোমার সামনে থেকে খা”।
শিক্ষার্থী কিংবা ঘরের সন্তান যদি ফরজের ক্ষেত্রে অবহেলা কিংবা ওয়াজিবের ক্ষেত্রে ঢিলেমি করে নরম ভাষায় সংশোধন করুন। প্রয়োজন হলে ধমক দিন, অতঃপর কঠোর ভাষায় সতর্ক করুন, যদি তাতে কাজ না হয় উত্তম-মাধ্যম করুন, তবে সালাতের জন্য দশ বছরের পূর্বে মারধর করা যথাযথ নয়।
একটি বিষয় স্মরণ রাখা জরুরি যে, মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তম-মাধ্যম বা শাসন বিলুপ্ত করার ঘোষণা অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল নিয়ে আসেনি, কারণ কতিপয় শিক্ষার্থী উত্তম-মাধ্যম ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা ব্যতীত তাদের বদ-অভ্যাস ত্যাগ করে না, এটা মনুষ্য স্বভাব। মারধর বিলুপ্ত করার পক্ষে অবস্থানকারীরা যত যুক্তি ও অজুহাত পেশ করুক তারা দূরদর্শী নয়। এতে সন্দেহ নেই যে, মারধর করার ক্ষেত্রে কতক শিক্ষক থেকে সীমালঙ্ঘন হয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে, তার অর্থ মারধর একেবারে বন্ধ করা নয়। ফকিহগণ বলেন, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কাউকে প্রহার করা বৈধ নয়, যার থেকে বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটে তাকে অবশ্যই তার জন্য জবাবদিহি করা উচিত।
“মাওসুয়াতুল ফিকহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ গ্রন্থে রয়েছে: “সকল আলেম একমত যে, বাচ্চারা যদি সালাত ও তাহারাত ত্যাগ করে এবং ফরজ শিখার ক্ষেত্রে শিথিলতা করে তাহলে অভিভাবকগণ তাদের শাসাবেন, সাত বছরের সময় কথার দ্বারা এবং দশ বছর পূর্ণ হলে প্রয়োজন সাপেক্ষে মারধর করবেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
্রعلموا الصبي الصلاة لسبع سنين , واضربوه عليها ابن عشر سنينগ্ধ.
“তোমরা বাচ্চাদের সালাত শিক্ষা দাও সাত বছরে এবং তার জন্য প্রহার কর যখন দশ বছর হয়”।
সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ডের ফতোয়া:
শিক্ষার্থীকে প্রহার করা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ডের প্রধান মুফতি বলেন: “আবু বকর রা. তার এক গোলামকে উট হারানোর কারণে মারধর করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কিছু বলেননি। শিক্ষক-শিক্ষিকা মনে রাখবেন, মারধর শিক্ষা দান করার এক উপকরণ ও শিক্ষার্থীর বক্রতা সোজা করার এক বৈধপন্থা, ক্রোধ ধমন কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার উদ্দেশ্যে মারধর করা বৈধ নয়। তাই একান্ত প্রয়োজনে প্রহার করার সময় লক্ষ্য রাখুন যেন ক্ষতি না হয়, শরীরে দাগ না কাটে, হাড্ডি না ভাঙ্গে, অঙ্গহানি না হয় ও ক্ষতের সৃষ্টি না হয়, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রلَا يُجْلَدُ أَحَدٌ فَوْقَ عَشَرَةِ أَسْوَاطٍ إِلَّا فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِগ্ধ.
“আল্লাহর হদ ব্যতীত দশটি বেত্রাঘাতের বেশী আঘাত করা যাবে না”। স্ত্রী অবাধ্য হলে প্রথমত উপদেশ প্রদান করুন, অতঃপর বিছানা পৃথক করুন, তাতে সংশোধন না হলে আল্লাহ মারধর করার অনুমতি প্রদান করেছেন, তবে তীব্র মারধর নয়। কারণ মারধর করার উদ্দেশ্য স্ত্রীর বক্রতা দূর করা, শক্তি প্রয়োগ ও প্রতিশোধ গ্রহণ করা নয়, শক্তি প্রয়োগ করা আদব শিক্ষা দেওয়ার সঠিক পন্থা নয়”।
শায়খ সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান বলেন, মারধর বাচ্চাদের শাসন করার বৈধ পদ্ধতি, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রمروا أولادكم بالصلاة لسبع واضربوهم عليها لعشرগ্ধ.
“সাত বছর হলে তোমরা তোমাদের সন্তানদের সালাতের নির্দেশ কর, এবং দশ বছর হলে তার জন্য প্রহার কর”। অনুরূপ স্ত্রী অবাধ্য হলে আল্লাহ তাকে শিষ্টাচার শিখানোর জন্য মারধর করার অনুমতি প্রদান করেছেন, তিনি বলেন:
﴿ وَٱلَّٰتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِي ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّۖ ٣٤ ﴾ [النساء : ٣٤]
“আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদের সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে প্রহার কর”। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
্রلَا يُجْلَدُ أَحَدٌ فَوْقَ عَشَرَةِ أَسْوَاطٍ إِلَّا فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِগ্ধ.
“আল্লাহর হদ ব্যতীত দশটি বেত্রাঘাতের বেশী কাউকে আঘাত করা যাবে না”।
মুয়াল্লিম ছাত্রকে এবং স্বামী স্ত্রীকে সংশোধন করার জন্য প্রয়োজন হলে মারধর করবেন। যারা প্রহারকে সংশোধন করার পদ্ধতি অস্বীকার করেন, তারা পাশ্চাত্যদের দ্বারা প্ররোচিত। তারা পাশ্চাত্যের আচরণ আমাদের দেশে আমদানি করতে চায়, কারণ তারা সেখান হতে শিক্ষিত এবং তাদের দ্বারা প্ররোচিত। পক্ষান্তরে আল্লাহ এবং তার রাসূল ও আদর্শ পূর্বপুরুষদের থেকে প্রমাণিত প্রহার সংশোধন করার একটি পদ্ধতি, তবে অবশ্যই সীমার ভেতর থাকা জরুরি, যেন তীব্র না হয়, চামড়া না ফাটে, হাড্ডি না ভাঙ্গে ও প্রয়োজন অতিরিক্ত না হয়”।
শায়খ ইবনে বায রহ. বলেন, “দশ বছর বয়স হলে সালাত ও বাড়ির কাজের জন্য অভিভাবকগণ সন্তানদের শাসন করবেন, প্রয়োজন হলে হালকা প্রহার করবেন, যেন কোনো ক্ষতি না হয় এবং উদ্দেশ্য হাসিল হয়”।
শায়খ মুহাম্মদ কুতুব বলেন, “মানুষকে আদব ও শিষ্টাচার শিখানোর জন্য শাস্তি প্রয়োগ করা স্বভাবগত বিষয়, বিশেষভাবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তাই বাচ্চাদের প্রতি দয়ার নামে তা অস্বীকার করা যায় না, কিংবা এ ক্ষেত্রে মুয়াল্লিমকে নিয়ন্ত্রণ করা যথাযথ নয়। বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা বলে, যে প্রজন্ম শাস্তি বিহীন ও শাস্তি নিষেধাজ্ঞার পরিবেশে বড় হয়, তারা অনেক ক্ষেত্রে অচেতন হয়, উন্নত জীবন গঠন ও কঠিন মুহূর্তে সামাজিক অবদান রাখতে তারা ব্যর্থ। অতএব অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। প্রহার না করার থিউরি যত মুখরোচক হোক, তা সবার জন্য কল্যাণকর নয়। শিক্ষার্থীদের উপর প্রকৃত দয়া হচ্ছে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য তাদেরকে যোগ্য করে তুলা, তাদের বিনষ্ট করার মাঝে কোনো দয়া নেই”।
প্রহার করার শর্তসমূহ
এতে সন্দেহ নেই যে, কতক শিক্ষার্থীকে মারধর ব্যতীত সংশোধন করা সম্ভব নয়, তবে তার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, যা রক্ষা করা হলে প্রহার সুফল বয়ে আনে এবং শিক্ষার্থীর জীবন বিচ্যুতি থেকে সংশোধনের পথে পরিচালিত হয়। নিম্নে মারধর করার কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করছি:
প্রথম শর্ত: পড়া-শুনায় অবহেলা কিংবা অসংলগ্ন আচরণের জন্য মুয়াল্লিম প্রথমধাপে শিক্ষার্থীকে প্রহার করবেন না, বরং প্রহার করার পূর্বের ধাপগুলো অনুসরণ করুন। ভুলগুলো স্মরণ করিয়ে দিন, বুঝান ও সংশোধন করুন, এতে কাজ না হলে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করুন, কিন্তু গালমন্দ ও খারাপ শব্দ প্রয়োগ করবেন না।
মুকাদ্দামাহ ইবনে খালদুনে বর্ণিত আছে, বাদশাহ হারুনুর রশিদ স্বীয় সন্তানের শিক্ষক মুহাম্মদ আমীনকে ওসিয়ত করেন, “প্রতিটা মুহূর্ত আপনি তাকে উপকৃত করার চেষ্টা করুন, তবে তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবেন না, তাহলে তার ব্রেন মেরে ফেলবেন। আর তাকে অধিক ছাড় দিবেন না, তাহলে সে অলসতাকে বেছে নিবে ও সময়ের অপব্যবহার করবে, যথাসম্ভব তাকে কাছে টেনে ও তার সাথে নম্র আচরণ করে তাকে সঠিক পথে রাখার চেষ্টা করুন, যদি সে এতে শুধরাতে না চায় তাহলে কঠোর হোন ও কঠোরতা করুন”।
দ্বিতীয় শর্ত: প্রহার করার জন্য শিক্ষার্থীর মাঝে আদব ও শিক্ষা কি জিনিস বুঝার জ্ঞান থাকা জরুরি, যারা বুঝে না তাদের মারধর করা বৈধ নয়। শিক্ষার্থীর বয়স ও অপরাধ উভয়ের প্রতি নজর রেখে শাস্তি প্রদান করা চাই, যেন কোনো ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন না হয়।
ছাত্রকে প্রহার করা সম্পর্কে ইমাম আহমদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন, “বাচ্চাদের অপরাধ অনুযায়ী প্রহার করা দোষণীয় নয়, তবে প্রহার করার পথ পরিহার করা ভালো, আর বাচ্চা অবুঝ হলে প্রহার করা বৈধ নয়”।
ফতোয়া বারজিলিতে রয়েছে, “শিক্ষার্থীরা কেউ হয় শক্তিশালী ও কেউ হয় দুর্বল, তাই তাদের অপরাধ ও শক্তি মোতাবিক প্রহার করা বাঞ্ছনীয়, কারণ সবার অপরাধ ও ধৈর্য ক্ষমতা সমান নয়”।
ইবনে হাজিব রহ. বাচ্চাদের মুয়াল্লিম সম্পর্কে বলেন, “যে সব বাচ্চা শরয়ী কারণ ব্যতীত স্বীয় দায়িত্বে অবহেলা করে, তাদের কারো জন্য শুধু চেহারার বিরক্তি প্রকাশ করা যথেষ্ট, কারো জন্য শক্ত কথা ও ধমকের প্রয়োজন হয়, আবার কাউকে প্রহার করা জরুরি হয়, প্রত্যেকের সাথে তাদের অবস্থা বুঝে ব্যবহার করা সমীচীন”।
তৃতীয় শর্ত: মুয়াল্লিম যদি মনে করেন প্রহার করলে সংশোধন হবে তাহলে প্রহার করবেন, অন্যথায় প্রহার করা বৈধ নয়। কারণ প্রহার করার উদ্দেশ্য সংশোধন করা, যদি সংশোধন না হয় তাহলে প্রহার করার কোনো অর্থ নেই।
চতুর্থ শর্ত: মুয়াল্লিম নিজে শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিবেন।
পঞ্চম শর্ত: গোস্বার সময় প্রহার না করা, কারণ তখন প্রহার করার উদ্দেশ্য সংশোধন না হয়ে গোস্বা নিবারণ করা হতে পারে।
ষষ্ঠ শর্ত: প্রহার করার সময় প্রহারের প্রকৃতি, পরিমাণ ও জায়গা ঠিক থাকা চাই। প্রকৃতি ঠিক থাকার অর্থ হালকা ও মৃদু প্রহার করা, পরিমাণ ঠিক থাকার অর্থ তিন বারের অধিক আঘাত না করা, জায়গা ঠিক থাকার অর্থ যেসব স্থানে প্রহার করা বৈধ নয় সেখানে প্রহার না করা, যেমন চেহারা, মাথা, বুক, পেট ও স্পর্শকাতর অঙ্গ। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
্রإِذَا قَاتَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَجْتَنِبِ الْوَجْهَগ্ধ.
“যখন তোমাদের কেউ আঘাত করে সে যেন চেহারায় আঘাত না করে”।
কখনো পরিবেশের কারণে শাস্তির ধরণ বিভিন্ন হয়, যেমন কোথাও কান ধরে দাঁড় করানো দোষণীয়, আবার কোথাও দোষণীয় নয়। তাই শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হলে অবশ্যই স্থানকাল পাত্র বিবেচনা করে রুচি সম্মত শাস্তি প্রদান করুন। প্রয়োজনে সহকর্মী, পরিচালক ও অন্যান্যদের সাথে শিক্ষার্থীর অপরাধ ও মুয়াল্লিমের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করুন।
সপ্তম শর্ত: হানাফি, মালিকি ও শাফিয়ি মাজহাবের অধিকাংশ ফকিহ বলেছেন বাচ্চাদের মারধর করার জন্য অভিভাবকের অনুমতি জরুরি। কারণ, শাস্তি প্রদান করা একটি শরয়ী বিধান, যা শাসক বা অভিভাবকের মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত। মুয়াল্লিম শাসক বা অভিভাবকের মর্যাদা সম্পন্ন নয়, তাদের প্রতিনিধি মাত্র, তাই তার শাস্তি প্রদান করার জন্য অভিভাবকের পূর্বানুমতি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য কাউকে প্রেরণ করার অর্থ মারধর করার অনুমতি প্রদান করা নয়, কারণ শিক্ষার সাথে তার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই। কতক অভিভাবক শিক্ষার অনুমতি দেন, কিন্তু মারধর করার অনুমতি দেন না, তাই তাদের চুপ থাকা সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি উভয় হতে পারে, অতএব স্পষ্ট অনুমতি ব্যতীত প্রহার করা যাবে না”।
হাম্বলি ও মালিকি মাজহাবের সর্বশেষ ফতোয়া ও শাফিয়ি মাজহাবের কতক ফকিহ বলেন, “শিক্ষার্থীকে প্রহার করার জন্য অভিভাবকরে অনুমতির প্রয়োজন নেই, কারণ, শিক্ষার্থীকে প্রহার করার ক্ষেত্রে সবার মৌন সমর্থন রয়েছে”।
অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত শিক্ষার্থীকে প্রহার করা বৈধ এ কথাই সঠিক। কারণ মুয়াল্লিমের প্রহার করার বিষয়টি সমাজে প্রচলিত, তার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয়ত অপরাধের জন্য শিক্ষার্থীকে প্রহার করা অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে হলে অন্যদের মাঝে ইনসাফ করা সম্ভব নয়। তখন মুয়াল্লিম অনুমতির ভিত্তিতে কাউকে মারবে, কাউকে মারবে না, এরূপ আচরণ এক প্রতিষ্ঠানে কল্যাণকর নয়।
যেসব প্রতিষ্ঠানে মারধর করা নিষেধ, সেখানে কাউকে ভর্তি করার অর্থ তাকে মারধর করার অনুমতি নেই। আর যেখানে মারধর করা নিষেধ নয়, সেখানে কাউকে ভর্তি করার অর্থ হচ্ছে সমাজের রীতি মোতাবেক প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রহার করা বৈধ।
অপরাধের শ্রেণীভাগ
শিক্ষার্থীদের অপরাধগুলো দু’প্রকার: ১. অপরাধের অনিষ্ট ও প্রভাব খোদ শিক্ষার্থীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে, তার দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, যেমন ক্লাসে অমনোযোগী থাকা বা ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা বা ক্লাসের পড়া যথারীতি সম্পন্ন না করা ইত্যাদি। এ জাতীয় অপরাধ গৌণ, তার জন্য শাস্তি কম হবে। এ সমস্যার জন্য অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করা ও তাদেরকে বিষয়গুলো জানিয়ে রাখা জরুরি। মুয়াল্লিম লক্ষ্য রাখবেন, কারো প্রতি বেশী যতœশীল হতে গিয়ে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের আমানত নষ্ট করা যাবে না।
২. শিক্ষার্থীর অপরাধের কারণে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন অন্যকে পড়তে না দেওয়া, কিংবা কারো শরীরে আঘাত করা বা ক্লাসে অস্বাভাবিক আচরণ করা, যার দ্বারা অন্যদের মনোযোগ ও পড়াশুনার পরিবেশ নষ্ট হয়। এ জাতীয় অপরাধ কোনো শিক্ষার্থী থেকে প্রথমবার সংগঠিত হলে খোদ মুয়াল্লিম সংশোধন করার চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে পরিচালক বা দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করুন। দ্বিতীয় বার সংগঠিত হলে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল, প্রয়োজনে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করুন, তারা আপনাকে অনেক সমাধান বলে দিবেন, বিশেষ করে অভিভাবকগণ।
এ জাতীয় অপরাধ যদি ক্লাসে বারবার সংগঠিত হয়, কিংবা তার দ্বারা পড়াশুনার পরিবেশ নষ্ট হয়, কিংবা অপরাধের প্রকৃতি মারাত্মক হয়, তাহলে দায়িত্বশীলদের তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে বলুন, কোনো কারণে বিলম্ব হলে দুষ্ট ছাত্রকে ক্লাসের বাইরে কিংবা অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন, যেন অন্য ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর এ জাতীয় অপরাধ যদি ক্লাসের বাইরে সংগঠিত হয় তাহলে তার শাস্তি প্রদান থেকে মুয়াল্লিমের বিরত রাখা নিরাপদ। ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের উপর তার বিচার ভার ছেড়ে দিন।
শিক্ষক শিক্ষার্থীকে গবেষণা করুন, তার স্বভাব, মানসিকতা ও শারীরিক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করুন, তার অপরাধ সম্পর্কে অভিভাবকের সাথে আলোচনা করুন, তারা আপনাকে শিক্ষার্থী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও সমাধানের পথ বাতলে দিবেন। কারণ কোনো শিক্ষার্থীর মাঝে কঠিন রোগ বা স্পর্শ কাতর অপারেশন থাকতে পারে, তখন সামান্য আঘাত বড় বিপদ ডেকে আনবে, তাই অপরাধ যত বড় হোক তাড়াহুড়ো পরিত্যাগ করুন। কারণ ক্ষমা করে ভুল করা ভালো, কিন্তু শাস্তি দিয়ে ভুল করা ভালো নয়।

1 টি মন্তব্য:

  1. মাশাআল্লাহ খুবই চমৎকার,বিশেষ করে শিক্ষকদের জন্য খুবই জরুরি

    উত্তরমুছুন